ভুটানের বিনিয়োগকারী ও স্থানীয় বাজারের চাহিদা সমন্বয় করে কুড়িগ্রামের ভুটান অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকলকারখানা গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়েছেন ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক। বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম সফরকালে তিনি এই আশ্বাস দেন।
ভুটানের রাজার আশ্বাস বাস্তবায়ন হলে সেখানে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা, যা ঘিরে আশায় বুক বাঁধছে দীর্ঘ দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রামের মানুষ।
বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১২টার দিকে কুড়িগ্রাম সার্কিট হাউজে পৌঁছান ভুটানের রাজা। এর আগে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নেমে সড়কপথে সেখান যান তিনি। মধ্যাহ্ণ ভোজ, বিশ্রাম শেষে দুপুর দেড়টায় পৌঁছান ধরলার পাড়ের চর মাধবরাম গ্রামে। যেখানে গড়ে ওঠার অপেক্ষায় জিটুজি-ভিত্তিক ‘ভুটান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’।
সেখানে ২০ মিনিট থাকেন রাজা। ঘূরে ঘুরে দেখেন, কথা বলেন ভুটান ও বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। আশ্বাস দেন– ভুটানের বিনিয়োগকারী ও স্থানীয় বাজারের চাহিদা সমন্বয় করে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে গড়ে তোলা হবে শিল্প কলকারখানা। পরে তিনি সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে সড়ক পথেই ফিরে যান ভুটান।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন। তিনি জানান, এখানে যত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করা যায় সে ব্যাপারে ভুটানের রাজা তাগিদ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, যখন কাজ শুরু হবে তখন তিনি নিজে আরও একবার কাজ পরিদর্শন করতে এখানে আসবেন। তিনি জায়গা দেখেছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখেছেন। একশ ভাগ সন্তুষ্ট তিনি।
শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, “মহামহিম রাজা যেটি বলেছেন সেটা হলো, লোকাল লোকজনের কী ধরনের চাহিদা রয়েছে এবং ভুটানের যারা বিনিয়োগকারী তাদের কী ধরনের চাহিদা রয়েছে– সবকিছু মিলিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি হচ্ছে, সবকিছু মিলিয়ে তারপরে ঠিক করা হবে কী ধরনের ইন্ডাস্ট্রিজ এখানে হবে। তবে এগ্রোবেজড এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখানে সিইটিপি, ইটিপি থাকবে। দূষণের সম্ভাবনা এখানে জিরো।”
কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য ডা. হামিদুল হক খন্দকার বলেন, “ভুটানের রাজা এখান থেকে হাসিমুখে গেলেন। খুবই সন্তুষ্ট। যত দ্রুত সম্ভব এটা চালুর কথা তিনি বলে গেলেন। আমি আশাবাদী দ্রুত কাজটি শুরু হবে। এলাকার লোকজন চাকরি করবে। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবে। অন্য দেশের সাথে কানেক্ট করে আমরা এটা করছি। এটা থেমে যাবে না। এটা প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রতিশ্রুতি ছিল, এখানে অর্থনৈতিক জোনের। এই এলাকার মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে। গত অধিবেশনেও আমি তাকে (প্রধানমন্ত্রী) বলেছিলাম অর্থনেতিক জোনের কথা। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামের জনগণের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য এটি চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। এখানে আমার এলাকার মানুষ কাজকর্ম করে খেতে পারবে।”
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ধরলা নদীর পাশে মাধবরাম গ্রামে গড়ে উঠতে যাচ্ছে বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘ভুটান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’। সম্ভব্যতা যাচাই করতে চলতি মাসের ১০ ও ১১ তারিখে নির্ধারিত স্থানসহ যোগাযোগ সংযোগের জায়গাগুলো পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশে ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামে জিটুজি-ভিত্তিক প্রস্তাবিত এই ‘ভুটান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বাস্তবায়ন হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান জানান, ১৩৩ দশমিক ৯২ একর খাস জমি বেজার কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এখানে আরও ৮৬ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা আছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসফিকুল আলম হালিম জানান, “কুড়িগ্রাম জেলার বড় অংশ চরাঞ্চল। এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কলকারখানা প্রয়োজন। এখান থেকে যেহেতু ভুটান অনেক কাছে সেহেতু ভুটানের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠার পর এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত হবে। রাজার পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে এই উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলেই আমরা মনে করি।”
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, ভুটানের রাজার আগমনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি তরান্বিত হলো। কুড়িগ্রামের সোনাহাট ও রৌমারী স্থলবন্দর এবং চিলমারী নৌ-বন্দরের সঙ্গে ভুটানের যোগাযোগ সুবিধা আছে। কুড়িগ্রামের সঙ্গে ভারত ও ভুটানের কানেক্টিভিটি খুবই ভালো। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠার মাধ্যমে শুধু জেলা নয়, এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। বিশেষ করে মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে।
ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল জানান, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত স্থানটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের উপযুক্ত। এখানে ভুটান বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে ভুটান ও বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে। কুড়িগ্রামের মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। এজন্য খুব দ্রুত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে ভুটান ও বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে সব প্রস্তুতি নিয়েছে। মহামহিম রাজার আগমনের মাধ্যমে এটি আরও প্রাণ পেল। খুব দ্রুত এর কাজ শুরু হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে জনসভায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের মে মাসে লন্ডনে ভুটানের রাজা ও রানির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সভায় কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ধারাবাহিকতায় কুড়িগ্রামে গড়ে উঠছে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর সঙ্গে কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর ও চিলমারী নৌ বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। এছাড়াও কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর হয়ে ভুটানের ফুন্টশোলিং এলাকার দূরত্ব কম। সহজে যাতায়াত করা যায়। ভুটানের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ হবে। পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে জেনে স্থানীয়দের মধ্যে বাড়তি আনন্দ বিরাজ করছে। কারণ দীর্ঘ মৌলিক উন্নয়ন বঞ্চিত ছিল এই এলাকার মানুষ। সে কারণে সব থেকে বেশি দারিদ্র্যপীড়িত এই জেলার মানুষ।
চিলমারী নৌ-বন্দর আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামান আহমেদ জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি তরান্বিত করার পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হবে। কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কুড়িগ্রাম সীমান্তে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাও দ্রুত চালু হবে। এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। দারিদ্র্য কমবে। এখন আমাদের একটাই দাবি– এটা যেন মাঝপথে থেমে না যায়। দ্রুত কাজ শুরু করা হোক।
কুড়িগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবদুল আজিজ জানান, “কুড়িগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে উৎপাদিত পণ্য যেমন দেশ ও দেশের বাইরে রপ্তানি করা সহজ হবে, তেমনি কম বেতনে পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া যাবে। ফলে ছোট শিল্পোদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারবেন এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও ভুটানের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নত হবে। জেলার মানুষকে আর ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে শ্রমিকের কাজ করতে হবে না। আমরা দ্রুত এর বাস্তবায়ন চাই।”
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সূত্র জানিয়েছেন, এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। খুব দ্রুত এর কাজ শুরু হবে।