“হৃদয় আমার চায় যে দিতে কেবল নিতে নয়
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তার যা কিছু সঞ্চয়”
নির্মাতার জীবনের সঞ্চয় কি! যা কিছু সে ক্যামেরায় ধারণ করে, যাদের জীবনচিত্র ধারণ করে এবং ধারণ করবার যাত্রায় যারা সাথী হয়, এই তো তার জীবনের মোদ্দা সঞ্চয়। এরকম এক পরম সঞ্চয়— সদ্য প্রয়াত পণ্ডিত অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধক ড. আনিসুর রহমান। তার সঙ্গে আমার ক্ষণিক চলার পথের স্মৃতি তর্পণের নিমিত্তে এ লেখা। গত ৭ জানুয়ারি তার শেষকৃত্যের একটা ছোট আয়োজন করা হয়েছিল শহীদ মিনারে। ওখানে গিয়ে মনে হলো যে চাপা বেদনা নিয়ে স্যার জীবন পার করে দিলেন তা আদতে কতটা সত্য, কতটা নগ্ন! এতবছর পর সেই সত্যের মুখোমুখি হয়ে কিছু লিখবার চেষ্টা, যদি তাতে আমার বেদনাবোধ কিছুটা প্রশমিত হয়…
আনিস স্যার ছিলেন আমার বাবার সরাসরি শিক্ষক। আব্বার কাছে শুনেছি, স্যার যখন ক্লাস নিতেন তখন অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররাও আসত লেকচার শুনতে। বেঞ্চে জায়গা হতো না। তাই মেঝেতে বসে, করিডোরে দাঁড়িয়ে তারা স্যারের লেকচার শুনত। এর বহুকাল পর আমার বাবার সেই আদর্শ শিক্ষকের সঙ্গে আমার সখ্য হয়ে গেল একটি ছবি নির্মাণের যোগসূত্রে। নির্মাতার সঙ্গে তার ছবির চরিত্রের সখ্য। এমনটা হয়ে থাকে, বিশেষ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে। চরিত্রকে এত গভীরভাবে জানতে হয়, ক্যামেরায় অন্বেষণ করতে হয় যে স্বাভাবিকভাবেই বোঝাপড়ার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে নির্মাতা আর প্রটাগনিস্টের মধ্যে। কিন্তু, বন্ধুত্ব তৈরি হওয়া বোধ করি অপ্রতুল। তেমন এক পরম স্নেহময় বন্ধুতা পেলাম আনিস স্যারের কাছে।
কখন? যখন আমার জীবনের কঠিনতম এক অধ্যায় অতিক্রম করছি। চারিদিকে দিকহারা শূন্যতা। দুঃখের দহনে আমি পুড়ছি, সামনে ভীষণ অনিশ্চিত পথ। স্যারের ওপর কাজটি করতে গিয়ে তার দর্শন ও বাণী আমার ছবির শুধু বিষয় হয়েই উঠল না, তা পাথেয় হলো। আমি সব সময় বলি, এ ছবি আমার লাইফ সেইভার, জীবনকে নতুন মানে দিয়েছে। স্যারের দর্শন আমাকে একটা দিকনির্দেশনা দিয়েছিল সেই মুহূর্তে। তা খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে আমি আবার থেমে যাওয়া পথ চলতে শুরু করি। জীবনকে রিস্টার্ট দেওয়া বলা যেতে পারে।
প্রামাণ্যচিত্রটির প্রিমিয়ার শো’তে সৈয়দ শামসুল হক এসেছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। তিনি এর একটা সুন্দর নাম দিয়েছিলেন, “Film Essay”। আমি নিজেও তাই মনে করি। কারণ কাজটা ছিল এসাইন্ড। ২০০৮ সালের ঘটনা, জীবন সঙ্কটে আছি। তাই নির্মাতা ও শিক্ষক মানজারে হাসীন মুরাদ ভাইকে বললাম আমার একটা কাজ চাই। মুরাদ ভাই বললেন, মেঘনা গুহঠাকুরতা আর শিপ্রা বোস একটা কাজের কথা বলছে ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। গেলাম মেঘনা’দির সঙ্গে দেখা করতে, শিপ্রা’দি দেশের বাইরে তখন। জানালেন, স্যারের সঙ্গীত ভাবনা নিয়ে “অসীমের সন্ধানে” বইটির একটা ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টশন করতে চান তারা। ভাবলাম এ আর এমন কি কঠিন কাজ! শুরু করে দিলাম।
কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, স্যারকে হ্যান্ডেল করাই আসল কঠিন কাজ। শুটিংয়ের জন্য করা আয়োজনে তিনি ক্যামেরাই বের করে দিচ্ছেন। যে কাজের জন্য যাওয়া, তাই করা যাচ্ছে না। মাকসুদুল বারী ছিলেন ক্যামেরায়, আমার শিক্ষক মানুষ। শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা আমার! ২/৩দিন কাজ করবার পর আমি রিয়েক্ট করলাম। বললাম, “স্যার আপনি যেমন চান আপনার কাজকে লোকে সম্মান করুক, তেমনি আমার কাজটাকেও আপনার সম্মান করতে হবে, নইলে যে কাজের জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে তা করতে পারব না।’’ এ কথায় স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমি প্রমাদ গোনা শুরু করলাম, ছবি বানানো তো দূর কি বাত! শুটিংয়ের খেল খতম হলো বলে! স্যার একটু পর বলে উঠলেন, “তোমার কথায় যুক্তি আছে। ঠিক আছে বলো, আমায় কী করতে হবে।’’
ব্যাস শুরু হয়ে গেল স্যারের সুরের ভুবনে আমার যাত্রা। ক্রমশঃ স্যার তার জ্ঞানের ঝুলি আমাদের সামনে তুলে ধরতে লাগলেন। স্যারের খোলা হাওয়ায় আমার ছোট্ট টিম তাদের কাছি টুকরো করে ডুবতে শুরু করল। বারী ভাই ফ্রেম চেইঞ্জ করতে ভুলে যান তো নজরুলের ব্যুম স্টিক কাত হয়ে হেলে পড়ে। আমাকে চোখের ইশারায় তা ঠিক করে দিতে হয়। ফরিদ তার প্রোডাকশনের তদারকি ভুলে ঠায় দাঁড়িয়ে স্যারের কথা শোনে, আমি তাকে ধমক দিতেও পারিনা পাছে স্যারের মেজাজ টুটে যায়। এরপর শুরু হলো সম্পাদনার প্রসেডিউর। স্যার এসে দু’তিন দফা ‘রাফ কাট’ দেখলেন মেঘনা’দি আর শিপ্রা’দিসহ। আমার কিছু ‘ডার্লিং মোমেন্ট’ কিল করে ফেলতে হলো তার অনুরোধে। কিন্তু, স্যারের সঙ্গে বন্ধুত্বটা হয়ে গেল। ফিলোসফিক্যাল বন্ধু বলা যায়। সঙ্গে অপার স্নেহ।
স্যার কোনওদিন জিজ্ঞেস করেননি আমার কী সমস্যা। শুধু বুঝতেন গভীর গাড্ডায় পরেছে তার ছাত্রের কন্যা। নিয়মিত ফোন করে খোঁজ নেওয়া, দু’একটা জীবনবোধের উত্তর দেওয়া। তাতে করে মনের সংশয় দূর হয়ে যেতে থাকল ক্রমে। শুটিং চলাকালীন আমার কোনও একটা প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন তিনি, “ইভিলের সঙ্গে কখনও লড়তে নেই। কারণ দিনশেষে সে ইভিল। ক্ষতি করবেই, পেরে উঠবে না। ইভিলের সঙ্গে লড়াই করতে হলে ইভিল হতে হয়। যদি তা হতে পারো তো করো লড়াই!’’
সেসময় একথা যে আমাকে কতটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল, কতটা শান্ত করে দিয়েছিল, সে আমি জানি! শুটিংয়ে বা শুটিংয়ের বাইরে স্যারের কথামালা, স্যারের সৎ পথে টিকে থাকার লড়াই, আদর্শবোধ ধারণ করে বেঁচে থাকা, যোগ্য মর্যাদা না পাবার বঞ্চনাবোধ আমাকে একাকী লড়াই করবার সামর্থ্য জুগিয়েছিল। তার অফুরান প্রাণশক্তি আমার মৃতআত্মায় প্রাণ সঞ্চার করছিল বিন্দু বিন্দু পথ্যের মতো। তাঁর অকুন্ঠ স্নেহ প্রলেপ হয়ে আমার গভীর ক্ষত সারিয়ে তু্লেছিল। সেই ঋণ তো শোধ করবার নয়!
স্যারের সোলমেট, তাঁর প্রেমিকা এবং স্ত্রী ডোরা ভাবী মারা গেলেন ২০১৫ সালে। এই প্রথম তরুণ আনিসুর রহমান বার্ধক্যে পা দিলেন যেন। তাঁদের প্রেম এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, স্যার তাঁদের বিয়ের রজত জয়ন্তীতে ডোরা ভাবীকে আবার বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। ভাবীর মৃত্যুর পর সেই যে স্যার প্রাণ হারিয়ে ফেললেন তা এই ১০ বছরেও আর ফেরত পেলেন না। তার শূন্য হয়ে যাওয়া জগত আর কিছু দিয়েই ভরে উঠল না।
একসময় স্মৃতি হারিয়ে ফেললেন তিনি, শয্যাশায়ী হলেন। শেষ যখন দেখতে গেলাম, তখন তিনি আমায় আর চিনতে পারেন না, আমার সঙ্গে তাঁর সুহৃদ হাবিবা, তাঁকেও নয়। কিন্তু আমরা যখন স্যারের সঙ্গে নানা কথা বলার চেষ্টা করছিলাম তখন হঠাৎ হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠছিলেন। হয়ত তাঁর অর্ধেক সত্তা চিনতে পারছিল আমাদের, পরমুহূর্তেই নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর অচেনা ভুবনের আগ্রাসী আক্রমণে। স্মৃতি তাঁকে হয়ত প্রতারিত করেছে। আমার মনে হতে থাকল, বরং এই ভালো, শান্তি দিয়েছে। স্যারের ভেতর আর কোনও বেদনাবোধ নেই, আঘাত নেই, যন্ত্রণা নেই। জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার গান শোনেন কিনা। মাথা নেড়ে না করলেন। শুনতে ইচ্ছে করে না? এবারেও যখন না করলেন, মনে হলো যেন অভিমান। ইচ্ছে করেই কি স্যার কিছু বুঝতে পারছেন না? না করলেন কেন তাহলে!
এ এক কঠিন যন্ত্রণা— যখন নির্মাতা তাঁর পূর্ণপ্রাণ চরিত্রকে ক্রমশঃ মরে যেতে দেখে। ‘সুরের হাওয়া ভুবন ভরে ছেয়ে’ যে ঘর, সেই ঘর যেন ছোটখাটো এক হাসপাতাল। একদা প্রাণ সঞ্চারী মানুষটি প্রাণ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য হাহাকার করছে অনুক্ষণ। সে দৃশ্য নেওয়া যায়না, বড় দুষ্কর তা বহন করা।
স্যারের অন্তেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফিরছি যখন, তখন ইচ্ছে করেই গাড়ির মুখটা ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে ঘোরালাম। শত বছরের প্রাচীন ক্যাম্পাস— যেখানে একসময় আনিস স্যার, আমার পিতা এবং আমি হেঁটে গেছি। আমাদের বন্ধন যেন একই সূত্রে গাঁথা। সে বন্ধন পরম্পরার নয়, বরঞ্চ আদর্শিক। একটা নীতির ওপর ভর করে চলা আমাদের পথ। সততা ছিল সে আদর্শের অবলম্বন। তাতে কার কী হয়েছে জানি না। এটুকু বলা যায়, আমাদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে। এই তিন প্রজন্মের লড়াই করবার পরিধি ভিন্ন যদিও।
আমার ভাবনা ঠেলে গাড়ি চলছে ট্র্যাক করে, আমিও চলন্ত দৃশ্য দেখে চলেছি। ঐ তো স্যার কলাভবনে লেকচার দিচ্ছেন… আমার তরুণ আব্বা সমীহ ভরা চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছে তা… ক্লাসরুমের বাইরে ক্ষুদে আঁতেল আমি কাঁধে ঝোলা ফেলে হনহন করে হেঁটে চলেছি কলাভবনের করিডোর ধরে, যে তখনও শ্রেণিসংগ্রামে বিশ্বাসী ছিল তার পিতা ও পিতার শিক্ষকের মতো … ঐ তো স্মৃতির শ্যাওলা মেখে দাঁড়িয়ে আছে ডিইউ লাইব্রেরি, কবি নজরুলের সমাধি, মলিন চারুকলা, স্যাঁতস্যাঁতে জাদুঘর… ক্যাওটিক শাহবাগ পেরিয়ে মিন্টো রোডে ঢুকতেই বৃটিশ আমলের মন্ত্রীপাড়া। মিন্টো রোড ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সব অট্টালিকা। সেখানে যেতেই দেখি প্রাচীন বৃক্ষের নিচে ভিখিরির কুড়িয়ে পাওয়া লাল কম্বল। এই ভরদুপুরে চারপাশের জ্যাম আর গাড়ির হর্নের মধ্যে দিব্বি মাথা মুড়ি দিয়ে ফুটপাতে ঘুমাচ্ছে দু’একজন। বৈভবের তলে সেই চিরচেনা দারিদ্র্য।
স্বগোক্তির মতো বললাম, স্যার আপনার সকল ভাবনার জলাঞ্জলি! সকল দর্শন, সকল গবেষণা ব্যর্থ। যাবতীয় এফোর্ট, উন্নয়ন ভাবনা, রবীন্দ্রদর্শন আজ আপনার দেহের মতোই মৃত। দারিদ্র্য নিরসনে আপনার “বিকল্প উন্নয়ন” থিওরি ভিন দেশে সমাদৃত হলেও এদেশে “বিকল্প” বিকল্পই থেকে গেছে। মার্ক্সবাদ বলি, সমতার রাষ্ট্র বলি সব ভেসে গেছে বঙ্গোপসাগরে। খুন হয়ে গেছে মানুষের সমতাভিত্তিক বন্টনের দাবি। শহীদ মিনারে যাঁরা এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে তাঁরাও মরা নদীর সোঁতার মতো বাম রাজনৈতিক দলের মানুষেরা। যাদের সোচ্চার অবস্থানের জন্য এদেশের রাজনীতির দাঁড়িপাল্লা খানিক হলেও ভারসাম্য বজায় ছিল আজ তা’ও যেন বিলুপ্ত। কারণ বিপ্লবীরা হয় দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত না হয় অর্থের সঙ্গে আপোস করে বিলাস ব্যাসনে ব্যস্ত। সমাজতন্ত্র এখন বিক্রয়শীল উপাদান। তাহলে কি আনিসুর রহমানের মতো অর্থনীতিবিদদের মৃত হয়ে যাওয়াই শ্রেয় নয়!
অমর্ত্য সেন ছিলেন স্যারের বন্ধু, পারিবারিক বন্ধু, এক ক্যাম্পাসে তারা দারুণ একটা সময় অতিবাহিত করেছেন। দেশের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু আনিস স্যারের ছাত্রই নয়, তার সহকর্মী ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনে। বিদেশের সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে তাঁরা দেশ গড়ার জন্য তুমুল উদ্যোগে কাজ করা শুরু করেছিলেন। এবং কিছুকাল পর তাঁরা অভিমান ভরে দেশ ছেড়েছিলেন। অভিমান শুধু অর্থনীতিবিদ হিসেবে নয়, তার সঙ্গীত সাধনার চলার পথেও জমেছে শুরুতেই। স্যার ছায়ানটের শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। বলা যায় ওয়ান অফ দ্য ফাউন্ডার্স। শুধুমাত্র রবীন্দ্র গায়কী কেমন হবে, এই তর্কে তাঁকে আলাদা করে দেওয়া হয়। সে অভিমান স্যার কোনওদিন ভুলতে পারেননি, মেনে নিতে পারেননি শিল্পের কূপমণ্ডুকতা। সবকিছু মিলিয়ে স্যার বহু আগেই একলা পথ চলা শুরু করেছিলেন।
স্যারের সেই একলা পথচলা রমণীয় করে রেখেছিলেন তার জীবনসঙ্গী ডোরা, তার সঙ্গীতের সাধনসঙ্গী। কোনও প্রত্যাশাবিহীন পথে স্যার সঙ্গীত সাধনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতকে ধরবার চেষ্টা করে গেছেন আজীবন— তাঁর ভাষায় অন্বেষণ। কতটা গভীরে ডুবলে সঙ্গীতের অতলকে স্পর্শ করা যায় তাই ছিল স্যারের প্রয়াস। সঙ্গীত থেকে আরোপিত যা কিছু বাহুল্য তা থেকে সঙ্গীতকে মুক্তি দেওয়াই ছিল তাঁর যুদ্ধ। যুদ্ধ বলছি এজন্যে যে তাঁকে তার সঙ্গীত দর্শনের কারণে দীর্ঘকাল একঘরে করে রাখা হয়েছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে তবলা পরিহার করবার জন্য, রবীন্দ্র সুর ও গায়কীর মতভেদের জন্য। অথচ, রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন সঙ্গীতের মুক্তির কথা। তবলা যেন তার গান আর সুরকে ছাপিয়ে যায়। আসল রস খর্ব করে।
আমরা যেদিন স্যারের বাসায় প্রথম ক্যামেরা ওপেন করেছি, স্যার গান গাইছেন “আজি তন্দ্রাহারা রাতে”। গান শেষ হলে, হারমোনিয়ামের রিড চেপে স্যার প্রথম যে কথাটি বললেন, ‘‘এই যে শুটিং ফুটিং করছ! আমার যেন দম্ভ না আসে!” আমি এই মুহূর্তটা রেখেছি ছবির শুরুর দিকে। কারণ স্যার মানুষ হিসেবে কেমন তা রিপ্রেজেন্ট করে এই এক বাক্য। ফিল্ম আমার কাছে কী? কিছু মুহূর্তের সন্নিবেশ। দিনশেষে জীবনও কি তাই নয়! কিছু মূহূর্তকে কব্জাবন্দি করবার জন্য নিরন্তর ছুটে চলা, অহর্নিশ নিজের মধ্যে পায়চারি করা।
স্যারের ওপর ডকুমেন্টারি করতে গিয়ে বেশ কিছু মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়, কুষ্টিয়ার শিলাইদা’তে রবীন্দ্রনাথের কুঠি বাড়িতে শুটিং চলছে। স্যার রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গানের বয়ান করছেন— বেদনার কথা, ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সংযোগ এবং সমর্পণের কথা। শুনছি আর আমার ভেতরে তোলপাড় চলছে। কারণ আগেই বলেছি, জীবনে ঝড় বইছে আমার। স্যার যেই বলে উঠলেন ‘‘যতবার আলো জ্বালাতে যাই, নিভে যায় বারে বারে/ আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে”… আর আমি যতবার কান্না আটকাতে যাই, ততবার চোখ পেরিয়ে গলগল করে তা বেরিয়ে আসে। স্যার বলে চলেন আর অঝোরে কাঁদি। স্যার কিন্তু থামছেন না। আমি কিন্তু তাঁর দিকে তাকিয়েই কাঁদছি। এত নিঃশব্দ সে কান্না যে আমার টিমের কেউ তা টের পাচ্ছেনা। শুধু স্যার দেখতে পাচ্ছেন তা। তিনি যেন নিরাময়কারী রূপ নিয়ে আমার ভেতরের জমাটবাঁধা বেদনাভার লাঘব হতে দিচ্ছেন। তিনি ততক্ষণই কথা বলে গেলেন যতক্ষণ না আমার চোখের জলের ধারা ক্ষীণ হয়ে এল। এরপর শেষ করলেন, ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তটাই স্যারের সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটিয়ে দিল। কোনও কথা না বলে এক দুঃখী মানুষের বেদনাকে ছুঁতে পারার যে পরম বন্ধু, তার সাক্ষাৎ মিলল আমার।
তেতাল্লিশ ঘণ্টার রাশ নিয়ে প্রায় ৩/৪ মাস টানা এডিট করেছিলাম “ভুবন ভরা সুর”-এর। সেসময় স্যারের কথা এবং গান সম্পাদনা করবার সময় কতদিন যে প্যানেলে বসে টানা কেঁদে গেছি! মনিটরে স্যার যখন গাইছেন, ‘‘সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা পথের তৃষা/ কেমন করে মেটাবো যে, খুঁজে না পাই দিশা!”— এ যেন নিজেকে সেলফ রিফ্লেক্টেড হতে শুনছি আমি। আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী এডিটর খুরশীদ আনাম সামনে বসে টের পেয়েছে একটু পেছনে বসা আমি কেঁদে চলেছি। আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু বাতাস তো ভারী হয়ে উঠছে। সেও নিঃশব্দ থেকেছে, অপেক্ষা করেছে কখন আমি পেছন থেকে বলে উঠব “কাট”! তাই-ই হয়ত ছবিটি শেষ করেছি স্যারের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের “আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগণতলে/ সে দিন যে রাগিনী গেছে থেমে/ অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে/ আজি পূবের হাওয়ায় হায় হায় হায় রে!/কাঁপন ভেসে চলে”।
২০০৯ এর মার্চ মাসের ৯ তারিখে প্রিমিয়ার শো হয় প্রামাণ্যচিত্রটির। খুব সুন্দর ছিল সে আয়োজন। ছবিটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়, লেখালেখি হয়, দেশের অনেক জায়গায় প্রদর্শন হয়। এমন কি কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্ট, শান্তিনিকেতনসহ দেশের বাইরেও। সবার আগ্রহের কারণে ডিভিডি’ও বের করেন মেঘনা’দি-শিপ্রা’দি। এবং প্রায় সব বিক্রিও হয়ে যায়। ছবির এক জায়গায় স্যার সাহানা দেবীর কথা উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রনাথ সাহানা দেবীর গান এতই ভালোবাসতেন যে, একদা বলেছিলেন ‘‘আমি যদি রাজা হতাম, তবে তোমাকে আমার অন্তঃপুরে বন্দী করে রাখতাম গান শোনাবার জন্য”।
প্রিমিয়ার শো’ শেষে মঞ্চে উঠে স্যার সেই কথার পুনরোক্তি করেছিলেন সেদিন আমার উদ্দেশ্যে। এ যে কত বড় পাওয়া তা আমি জানি! স্যার তো আমাকে একথা বলবার আগেই আমাকে বন্দি করে ফেলেছেন তাঁর স্নেহে, তার লালিত আদর্শে। এ বন্দিত্ব স্বেচ্ছায়, আত্মসমর্পণের মতো মধুর সে বন্দিত্ব। ঐ যে ররি ঠাকুরের ভাষায়, “মধুর তোমার শেষ যে না পাই/ প্রহর হলো শেষ/ ভুবনজুড়ে রইলো লেগে আনন্দ-আবেশ”। এবারে সেই জাগতিক বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে স্যার পাড়ি জমালেন আরেক ভুবনে। সুরে ভরা সে ভুবন। সে অপার্থিব ভুবনে পৌঁছে নিশ্চয় অরূপের সন্ধান পেয়েছেন স্যার!
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা