যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থীতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত রবিবার নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে নতুন প্রার্থী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নাম প্রস্তাব করেন তিনি।
দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলে ৫ নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে লড়বেন কমলা হ্যারিস। আগামী ২২ আগস্টের মধ্যে এই বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। সেদিন দলের জাতীয় কনভেনশনের শেষ দিনে হ্যারিসের প্রার্থীতা চূড়ান্ত করা হবে। ১ আগস্ট থেকেই হ্যারিসের প্রার্থীতা চুড়ান্ত করতে দলের ডেলিগেটদের ভোটাভুটি সহ অন্য প্রক্রিয়া শুরু হবে। জাতীয় কনভেনশন হবে ১৯-২২ আগস্ট।
কমলা হ্যারিস অবশ্য এরই মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। সোমবারের মধ্যেই তিনি দলের প্রায় ৪ হাজার ডেলিগেটের মধ্যে ১ হাজার ৯৭৬ জনের সমর্থন পেয়েছেন। দলের জাতীয় সম্মেলনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হতে এই সমর্থনই যথেষ্ট। ডেলিগেটদের সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পরই জোরালোভাবে নির্বাচনী প্রচারও শুরু করেন কমলা হ্যারিস।
বাইডেনকে কেন সরতে হলো
জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট। তার বয়স এখন ৮১ বছর। এই বয়স নিয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কতটা ভালো করতে পারবেন তা নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন ছিল। তবুও দলের ডেলিগেটরা তাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। সে অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারও শুরু করেছিলেন বাইডেন।
কিন্তু বাদ সাধে গত ২৭ জনু ট্রাম্পের সঙ্গে তার প্রথম সরাসরি নির্বাচনী বিতর্ক। বিতর্কে তিনি ট্রাম্পের কাছে ধরাশায়ী হন। এরপর থেকেই বাইডেনের ওপর সরে যাওয়ার চাপ বাড়ছিল। একের পর এক ডেমোক্র্যাট সেনেটর এবং এমপি তাকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
এমনকি ডেমোক্র্যাটিক দলের অর্থ দাতারাসহ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও কলামিস্টরাও তাকে মাথা নত করার আহ্বান জানান। বাইডেন সরে না দাঁড়ালে পার্টির নির্বাচনী তহবিলে অর্থ না দেওয়ার ঘোষণাও দেন প্রভাবশালী ডিজনি পরিবারসহ অনেক দাতা।
এত কিছুর পরও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে অনড় ছিলেন বাইডেন। নিজেকে তিনি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সেরা প্রার্থী বলেও ঘোষণা করেন। তিনি বারবার নিজেকে পুরোপুরি সুস্থ ও সক্ষম দাবি করেন।
তবে ডেমোক্র্যাটরা বাইডেনের ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না। বাইডেনও তাদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি ফিট আছেন।
এছাড়া বাইডেন একের পর এক ভুলও করে চলছিলেন। চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সম্মেলন হয় ওয়াশিংটনে। সেখানে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নাম নিয়ে গড়বড় করে ফেলেন তিনি।
সম্মেলনে বাইডেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলে সম্বোধন করেন। এমনকি ন্যাটো সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নামও ভুল করেন। কমলার নামের জায়গায় বাইডেন ট্রাম্প বলে ফেলেন।
সংবাদ সম্মেলনে রয়টার্স বাইডেনের কাছে জানতে চায়, কমলা হ্যারিসের ওপর তার আস্থা আছে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘দেখুন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা না থাকলে তো আমি ট্রাম্পকে (কমলাকে) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিতাম না।’
সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন ঘন ঘন কাশছিলেনও। সংবাদ সম্মেলনের শুরুর দিকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় তিনি কথার খেইও হারিয়ে ফেলছিলেন। শেষের দিকে তার কথাগুলো খুব একটা স্পষ্টভাবে বোঝাও যাচ্ছিল না।
এতে বাইডেনের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে লাস ভেগাসে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বাইডেনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর তিনি সব প্রচার বন্ধ করে ডেলাওয়ারে নিজ বাসভবনে আইসোলেশনে (নির্জনবাসে) যান। সেখান থেকেই গত রবিবার প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তিনি।
ট্রাম্পকে কী হারাতে পারবেন কমলা
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয় পেলে ৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন। তাকে নিয়ে বড় আশা দেখছেন ডেমোক্র্যাট দলের শীর্ষস্থানীয়রা। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘অত্যন্ত গর্ব ও সীমাহীন আশা নিয়ে’ তিনি কমলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। বাইডেনও প্রশংসা করে তাকে ‘সেরা’ বলেছেন।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অর্থদাতারাও যে কমলাকে নিয়ে আশাবাদী, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর নির্বাচনী প্রচার তহবিলে তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ থেকে। বাইডেন সরে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টায় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার জমা পড়েছে দলটির নির্বাচনী তহবিলে।
ডেমোক্র্যাট শিবির বলছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে এর আগে কখনও এক দিনে এত অর্থ সংগৃহীত হয়নি। আর এই অর্থদাতাদের মধ্যে ৮ লাখ ৮৮ হাজার জন তৃণমূলের নেতা-কর্মী রয়েছেন। তাদের ৬০ শতাংশই ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো অর্থ দিয়েছেন।
জনমত জরিপগুলোতেও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জোর টক্কর দিচ্ছেন কমলা হ্যারিস। রয়টার্স/ইপসোসের সর্বশেষ জরিপে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি। গত সোম ও মঙ্গলবার এই জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা যায়, কমলার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ শতাংশ ভোটার এবং ট্রাম্পের প্রতি ৪২ শতাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছেন।
নিবন্ধিত ভোটারদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ মনে করেন, ৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানসিকভাবে দক্ষ ও পুরোপুরি সক্ষম রয়েছেন। বিপরীতে ৪৯ শতাংশ মনে করেন, ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্পের এই সক্ষমতা আছে।
নিজ দলেও কমলার প্রতি সমর্থন বাইডেনের চেয়ে বেশি। ৮০ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার বলেছিলেন, তারা বাইডেনকে সমর্থন করেন। কমলার বেলায় সেই সমর্থন বেড়ে ৯১ শতাংশ হয়েছে। আর দল ও ভোটারদের এখন সব বিভক্তি ভুলে কমলাকে সমর্থন করা উচিৎ বলে মনে করেন তিন-চতুর্থাংশ ডেমোক্র্যাট ভোটার।
সিএনএন এর জরিপেও দেখা গেছে, হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। মঙ্গলবার প্রকাশিত সিএনএন/এসএসআরএস জরিপে দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে হ্যারিসের সমর্থন ৭৮ শতাংশ, আর ট্রাম্পের সমর্থন মাত্র ১৫ শতাংশ।
এই একই ভোটারদের মধ্যে গত এপ্রিল ও জুনে চালানো জরিপে দেখা যায়, বাইডেনের সমর্থন ছিল ৭০ শতাংশ আর ট্রাম্পের ছিল ২৩ শতাংশ।
বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর হিসপ্যানিক ভোটারদের মধ্যেও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি সমর্থন বেড়েছে। হিসপ্যানিক ভোটারদের মধ্যেও ৪৭ শতাংশ সমর্থন নিয়ে হ্যারিস ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে। হ্যারিসের বিপরীতে হিসপ্যানিকদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। যেখানে বাইডেনের বিপরীতে হিসপ্যানিকদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন ছিল ৫০ শতাংশ। আর বাইডেনের সমর্থন ছিল ৪১ শতাংশ।
তরুণদের মধ্যেও বাইডেনের চেয়ে হ্যারিসের জনপ্রিয়তা বেশি। নতুন জরিপে দেখা গেছে, ৩৫ বছরের কম বয়সী ভোটারদের ৪৭ শতাংশ হ্যারিসকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। হ্যারিসের বিপরীতে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছে ৪৩ শতাংশ তরুণ।
গত এপ্রিল ও জুনে এই একই ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্পের প্রতিই বেশি সমর্থন দেখা গেছে। সেসময় ৪৯ শতাংশ তরুণ ভোটার বলেছিলেন, তারা ট্রাম্পকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। বিপরীতে বাইডেনকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছিলেন মাত্র ৪২ শতাংশ।
তবে এসব ভোটারদের মধ্যে ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেনের প্রতি যে পরিমাণ সমর্থন ছিল, হ্যারিস তার চেয়ে অন্তত ৫ পয়েন্ট পিছিয়ে রয়েছেন।
২০২০ সালের প্রচারাভিযানের শেষে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে বাইডেনের সমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮৪ শতাংশে। আর ট্রাম্পের সমর্থন নেমে গিয়েছিল মাত্র ৯ শতাংশে। হিসপ্যানিক ভোটারদের মধ্যেও বাইডেনের সমর্থন হ্যারিসের চেয়ে বেশি ছিল। গত নির্বাচনে হিসপ্যানিকদের মধ্যে ট্রাম্পের ৩২ শতাংশের বিপরীতে বাইডেনের সমর্থন ছিল ৫৮ শতাংশ।
তরুণ ভোটারদের মধ্যেও ২০২০ সালের প্রচারাভিযান শেষে বাইডেনের সমর্থন হ্যারিসের তুলনায় বেশি ছিল। সেবার তরুণদের ৬০ শতাংশ বাইডেনকে সমর্থন জানিয়েছিল। আর ট্রাম্পের সমর্থন ছিল মাত্র ৩১ শতাংশ।
তার মানে হলো, এই ভোটারদের মধ্যে নিজের সমর্থন আরও না বাড়াতে পারলে হ্যারিসের পক্ষে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয় পাওয়া কঠিন হবে। অবশ্য বাইডেনের চেয়ে হ্যারিসের সমর্থন বাড়ানো ও জয়ের সম্ভাবনা বেশি।
কমলা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং প্রথম এশিয়-আমেরিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি বাইডেনের রানিং মেট ছিলেন। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি হবেন দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, রয়টার্স, আল জাজিরা, বিবিসি