যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আইনজীবী রবার্ট কে হুর সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা ঘিরে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
‘প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কীভাবে গোপন নথি সামলান’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বাইডেনকে ‘দুর্বল স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বৃদ্ধ ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক মাস আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হুরের ৩৮৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হ্রাস পায় কিনা। এ নিয়ে একাধিক স্নায়ুবিজ্ঞানী তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
রিপাবলিকানরা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বয়স ও মানসিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা হুরের প্রতিবেদনটিকে রাজনৈতিক বলে সমালোচনা করেছেন।
ডেমোক্রেট পার্টির কৌশলবিদ জোন রেইনিশ বলেন, ‘‘এটি সত্যিই উদ্বেগজনক। এই দুই ব্যক্তির (বাইডেন ও ট্রাম্প) প্রতি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশভঙ্গি আমাদের বিবেচনা করতে হবে। বাইডেনের কোনও ভুল হলে তা নিয়ে হইচই ও প্রচার ১০ হাজার গুণ বেশি হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন অসংলগ্ন ও অসত্য বলেন তখন তার সমালোচনা খুব কম দেখা যায়।”
হুরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাইস প্রেডিডেন্ট হিসেবে কত সময় দায়িত্ব পালন করেছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক সময়কাল মনে করতে পারেননি বাইডেন। এছাড়া তার ছেলে বো বাইডেন কবে মারা যান, সেই সময়ও তার মনে ছিল না।
যদিও সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বাইডেনকে দৃঢ়কণ্ঠেই বলতে শোনা যায়, “আমার স্মৃতিশক্তি ভালো আছে।”
বক্তব্যে বিদেশি নেতাদের নাম ভুলে যাওয়ায় ৮১ বছর বয়সী বাইডেন বেশ সমালোচিত হয়েছেন।
তবে হোয়াইট হাউসের চিকিৎসক ড. কেভিন ও’কনর সম্প্রতি দাবি করেছেন, দায়িত্বপালনের জন্য বাইডেন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। নতুন করে কোনও জটিলতা দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বছরে একবার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ড. কেভিন বাইডেনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এসব কথা বলেন।
মেরিল্যান্ডের সামরিক হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় বাইডেনের। পরীক্ষা শেষে ড. কেভিন জানান, প্রেসিডেন্টের স্বাস্থ্য গত বছরের মতোই আছে। উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি।
বিবিসি বলছে, বাইডেনের এখনও অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের চিকিৎসা চলছে। এই সমস্যার জন্য তিনি রক্ত পাতলা করার ওষুধ খাচ্ছেন। এছাড়া তার পেটে গ্যাসের সমস্যা ও রক্তে চর্বি রয়েছে। তিনি গত গ্রীষ্ম থেকে ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া রোধে যন্ত্র ব্যবহার করছেন, যাকে সিপিএপি বলে।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিচিত ব্যক্তিদের নাম ভুলে যাওয়া বা অতীতের ঘটনার তারিখ মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া, বিশেষ করে চাপের মধ্যে, বয়সের সঙ্গে স্বাভাবিক পরিবর্তনের অংশ হতে পারে।
ভ্যান্ডারবিল্ট আলঝেইমার রোগ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ডা. পল নিউহাউস বলেন, “আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমার মায়ের মৃত্যু কখন হয়েছিল। সঠিক বছরটা মনে করতে পারব না। কারণ সেটা অনেক বছর আগের ঘটনা। প্রায় প্রতিটি বয়স্ক রোগীরই মানুষের নাম মনে রাখার সমস্যা হয়। আমার মনে হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মধ্যেই স্মৃতিশক্তি হ্রাস নিয়ে অভিযোগ বাড়ে।”
তার অভিজ্ঞতা অনুসারে, এই ধরনের ভুলে যাওয়া আসলে, কে স্মৃতিশক্তি হ্রাসের সমস্যায় ভুগবেন তার পূর্বাভাস দেয় না।
মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু একজন ব্যক্তির ডাক্তার বা স্নায়ুবিজ্ঞানীই এই রোগ নির্ণয় করতে পারেন, বাইরের পর্যবেক্ষকরা নয়।
বোস্টনের ব্রিঘাম অ্যান্ড উইমেন্স হাসপাতালের অ্যান রোমনি সেন্টার ফর নিউরোলজিক ডিজিজেসের সহ-পরিচালক ডা. ডেনিস সেলকোও মনে করেন, নাম ভুলে যাওয়া আসলে সম্ভাব্য স্মৃতি সমস্যার কোনও গুরুতর ইঙ্গিত দেয় না। কাজ-মানসিক চাপ ও ঘুমের অভাব, যে কোনও বয়সের ব্যক্তির স্মৃতিশক্তিতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, “শুধু কিছু নাম ভুলে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে একজন ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি হ্রাসের সমস্যা আছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।”
স্বাভাবিক স্মৃতি পরিবর্তন কী
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোন হেলথের আলঝেইমারস ডিজিস রিসার্চ সেন্টার ও কগনিটিভ নিউরোলজি সেন্টারের পরিচালক ড. থমাস উইসনিউস্কি বলেন, “বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন তথ্য মনে রাখা ও পুনরুদ্ধারে কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বিচার করার মতো মানসিক প্রক্রিয়া আরও উন্নত হতে পারে।
“স্মৃতিশক্তির ক্ষমতা বয়সের সঙ্গে কিছুটা হ্রাস পায়। তবুও জ্ঞান বাড়তে পারে, কারণ ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কী করা সবচেয়ে ভালো, সে সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি পায়।”
ডা. পল নিউহাউসের মতে, মাঝে মধ্যে নাম ভুলে যাওয়া বা ভুল নামে ডাকা কোনও সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো যখন কারও সাম্প্রতিক বা অতীতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা মনে না রাখতে পারে, তাহলে তা ‘এপিসোডিক’ স্মৃতি সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে। তবে এটি কিন্তু সবসময় কোনও গুরুতর রোগের লক্ষণ নয়।
এপিসোডিক স্মৃতি হলো মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতি, যা নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি আমাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, যেমন ছুটি কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, বা গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো মনে রাখতে সাহায্য করে।
উইসনিউস্কির মতে, অনেকে নিজেরাই বুঝতে পারেন না যে তিনি ভুলে যাচ্ছেন।
ডা. পল নিউহাউস বলেন, “সাধারণত স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা অনেক বছর আগের ঘটনা মনে না রাখার চেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা মনে না রাখার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। কারণ ডিমেনশিয়া প্রথমে মস্তিষ্কের সেই অংশকে প্রভাবিত করে যা সাম্প্রতিক স্মৃতির জন্য দায়ী, দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতির জন্য নয়।
“আমার চিন্তার মূল বিষয় হলো, আপনি কি গতকালের ঘটনা মনে রাখতে পারছেন? অথবা এক ঘণ্টা আগের ঘটনা?”
ডা. ডেনিস সেলকো বলেন, “বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্মৃতিশক্তি ও কার্যনির্বাহী ক্ষমতা কমে যাওয়া নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও, বয়স বাড়ার কিছু জ্ঞানগত সুবিধাও রয়েছে।
“দীর্ঘ জীবনের সঙ্গে আসে এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা ও জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা। মানুষ আরও সাবধানে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
তথ্যসূত্র : এনবিসি নিউজ, এপি, নিউ ইয়র্ক টাইমস