Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

ছোট মনে বড় আতঙ্ক এখন হেলিকপ্টার

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবেলায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকার আকাশে উড়তে দেখা যায় হেলিকপ্টার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবেলায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকার আকাশে উড়তে দেখা যায় হেলিকপ্টার। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার কাজলা এলাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করে নয় বছরের শিশু জুঁই। তার ভীষণ প্রিয় পাখি কবুতর। মেয়ের কবুতরপ্রীতি দেখে বছর খানেক আগে বাসার ছাদে কবুতর পালতে শুরু করেন বাবা রাজু আহমেদ।

এরপর থেকেই জুঁইয়ের অন্যতম কাজ হয়ে ওঠে সকাল-বিকাল কবুতরগুলোকে দেখতে ছাদে যাওয়া, তাদের খাবার দেওয়া, দেখভাল করা। কোনও কবুতর অসুস্থ হলে বাবাকে অস্থির করে ফেলত সে। কোনোটি ডিম দিলে বা বাচ্চা ফুটলে আনন্দের সীমা থাকত না তার।

সেই জুঁই গত কয়েকদিন ধরে আর ছাদে যায় না। কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন থেকে সৃষ্ট সহিংসতার সময় তাদের বাসার ওপর দিয়ে এত হেলিকপ্টার ওড়াউড়ি করেছে, এত সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেলের আওয়াজ সে শুনেছে যে, ছাদে যাওয়াই তার কাছে এখন এক আতঙ্কের নাম।

জুঁইয়ের বাবা রাজু আহমেদ বলেন, “গত কয়েকদিন মানুষের দৌড়ঝাঁপ আর আহতদের আহাজারিতে বাসার আশপাশে আতঙ্কিত পরিবেশ তৈরি হয়। এসব দেখে হেলিকপ্টার নিয়ে একটা ভয় ঢুকে গেছে জুঁইয়ের মনে। এখন নিজের প্রিয় কবুতর দেখতেও আর ছাদে যায় না ভয়ে।”

আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার, নিচে বিক্ষোভকারীদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন পুলিশ সদস্যরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার, নিচে বিক্ষোভকারীদের দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন পুলিশ সদস্যরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। একপর্যায়ে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে টহল শুরু হয়।

কোথাও কোথাও সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়াশেল ছোড়া হয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই দিবাগত রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার।

কাজলা এলাকায় জুঁইদের বাড়ি। যাত্রাবাড়ী থানার এই এলাকায় কোনও সহিংসতা না হলেও আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

রাজু জানালেন, কাছাকাছি হওয়ায় যাত্রাবাড়ি এলাকার সহিংসতার রেশ পড়েছে এই এলাকায়। সহিংসতার চলাকালে অনেক মানুষ দৌড়ে কাজলা এলাকায় চলে এসেছিলেন। এসময় কাজলার ওপর দিয়েও একটু পর পর হেলিকপ্টার চক্কর দেয়। বেশ কয়েকদিন এই অবস্থা চলেছে। সেই থেকে হেলিকপ্টারভীতিতে ভুগছে জুঁই।

হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া টিয়ারশেল ও গ্রেনেডের বেশ কয়েকটি ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকার ভেতরেও বিস্ফোরিত হয়। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিশুরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

তাদেরই একজন ৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ আফরাজ। তার বারা আল ইমরান সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তিনি।

আল ইমরান বলেন, “গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে আমার ছেলে এতই আতঙ্কিত হয়েছে যে এখন বাসার বারান্দায় যেতেই ভয় পাচ্ছে।”

অনিক মৃধা নামে যাত্রাবাড়ির আরেক অভিভাবক বলেন, “আমার মেয়েটা ক্লাস ফাইভে পড়ে। সেই মেয়েকে আগে যেখানে উৎসাহ নিয়ে হেলিকপ্টার দেখাতাম সে এখন হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলে আগে থেকে সাবধান হয়ে যাচ্ছে। কারণ ও জেনেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখেছে কীভাবে হেলিকপ্টার থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ার করা হচ্ছে। এসব দেখে আমার মেয়েটা হেলিকপ্টারকে ভয়ঙ্কর কিছু ভেবেছে।”

১৯ জুলাই থেকে টানা দুইদিন মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।

বসিলার ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ের বাসিন্দা ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, “আমার ৭ বছর বয়সী ছেলের প্রিয় খেলনা ছিল হেলিকপ্টার। আগে হেলিকপ্টার ওড়ার শব্দ পেলে দৌড়ে ঘরের বাইরে যেত, আর এখন হেলিকপ্টারের শব্দে বাইরে থেকে দৌড়ে বাসায় চলে আসছে। এসে বলছে ‘মা দুষ্টু হেলিকপ্টার এসেছে, লুকাও।’ হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড মারতে দেখে ও খুব ভয় পেয়েছে।”

ঢাকার আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রিয় হেলিকপ্টার এখন অনেক শিশুর কাছে আতঙ্কের নাম। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকার আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রিয় হেলিকপ্টার এখন অনেক শিশুর কাছে আতঙ্কের নাম। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

কোটারিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে উত্তরাতেও। এই এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী ইদ্রিস আলম। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় মিশকাত আলম। স্থানীয় একটি কিন্ডাগার্টেনের শিক্ষার্থী সে।

সহিংসতার সময় তাদের বাসা থেকেই দেখা গেছে মারামারি, গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। ইদ্রিস বলেন, “মারামারি আর গুলি দেখে আমার ছেলেটা খুব ভয় পাইছে। একেতো স্কুল বন্ধ, তার মধ্যে মারামারির কারণে বাইরেও যেতে পারছে না। এখন সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে।”

শিশুদের এই মানসিক অবস্থা এবং এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে কথা হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “যেকোনো পরিবর্তিত অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে যখন একটা বিপর্যয় ঘটে তখন শিশুসহ সবারই মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যখন স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গেল, চারিদিকে তারা মৃত্যু প্রত্যক্ষ করল, ধ্বংসযজ্ঞ দেখল, তারপর তারা হঠাৎ করেই একটা কারফিউয়ের মধ্যে পরে গেল, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল। শিশুরা যখন চারিদিকে এরকম একটা হিংসাত্মক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করল তখন তাদের ভেতরে একটা তীব্র মানসিক চাপ, উৎকণ্ঠা, ভয়, অনিশ্চিয়তা তৈরি হলো।

“পাশাপাশি পরিবারের যারা প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য আছেন তাদের কেউ ভয়ার্ত হয়েছে, কেউ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের সেই দুঃশ্চিন্তা কিংবা ভয়ও শিশুদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। ফলে এই সময়টাতে শিশুদের মধ্যে একটা তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।”

এই চাপ দীর্ঘায়িত হলে শিশুদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে জানালেন এই চিকিৎসক। যা পিটিএসডি (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) বা আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ হিসেবেও দেখা দিতে পারে।

এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ড্যামেজ কন্ট্রোল বা ক্ষতি কমানোর কথা বললেন তিনি।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরাতো আর ব্যাক গিয়ারে যেতে পারব না, তবে যে মানসিক ক্ষতিটা হয়েছে সেটা কমিয়ে আনা যেতে পারে। সেজন্য শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, তাদের ক্লাসরুমগুলো দ্রুত খুলে দেওয়া প্রয়োজন। এতে তাদের মনের কষ্ট, দুঃখ, অনুভূতিগুলো অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে।

“এছাড়া শিশুদের দৈনন্দিন যে অ্যাক্টিভিটি সেগুলো যাতে তারা করতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়াও পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো ও তারা ঘরে বাইরে যেখানেই খেলাধুলা করতো সেটার ব্যবস্থা করতে হবে।”

তবে এসব সহিংসতার ঘটনায় শিশুদের ভয় পাওয়া বা মন খারাপকে দুর্বলতা নয় তাদের মানবিক গুণাবলি হিসেবেই দেখছেন এই চিকিৎসক।

এমন সংঘাত শিশুমনে ফেলছে বিরূপ প্রভাব। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তিনি বলেন, “তাদের ভেতরে এখনও মানবিক গুণাবলি আছে বলেই সহিংস ঘটনায় তাদের মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের পাশে বড়দের থাকতে হবে। তাদের আশ্বস্ত করতে হবে, কোনোভাবেই ভয় দেখানো যাবে না।”

যে শিশুটি হেলিকপ্টারের ভয়ে প্রিয় কবুতর দেখতে যাচ্ছে না সেই শিশুটিকে বোঝাতে হবে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলো অন্য কোনও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত। তাকে বোঝাতে হবে হেলিকপ্টার কোনও নিষিদ্ধ বা ভয়ঙ্কর জিনিস নয়। কোনও একটা পরিস্থিতির কারণেই হেলিকপ্টারগুলোকে সেখানে যেতে হয়েছে।

বিষয়টিকে শিশুর কাছে স্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরতে পরামর্শ দিলেন তিনি।

তাকে বোঝাতে হবে, চাইলে সে বড় হয়ে হেলিকপ্টার চালাতে পারে। তাকেও প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত হতে পারে, সে নিজেও যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে পারে।

তাই যেকোনো বিপদ বা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতর মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা যাতে শিশুর তৈরি হয় সে বিষয়ে এখন থেকেই অভিভাবকদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বললেন, “শিশুদের বোঝাতে হবে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে হেলিকপ্টারটি এসেছিল, এটি তোমার ক্ষতির জন্য আসেনি। এটাকে তোমার ভয় পাওয়ার বা প্রতিপক্ষ ভাবার কোনও কারণ নেই। তা না হলে শিশুটির মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। তাই কোনও কিছুকেই শিশুর প্রতিপক্ষ বানানো যাবে না।

“শিশুদের বোঝাতে হবে রাস্তায় যারা মিছিল করেছে কিংবা যারা হেলিকপ্টারে এসেছিল কেউ তার প্রতিপক্ষ না। প্রত্যেকেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এই আচরণগুলো করেছে।”               

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত