Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

বিরল সম্ভাবনার দুয়ার কি আদৌ খুলবে

দীর্ঘ ১৮ বছর পরও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর।
দীর্ঘ ১৮ বছর পরও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর।
[publishpress_authors_box]

আঠারো বছর কেটে গেলেও পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু হয়নি দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর। কোভিড মহামারির পর বন্ধ থাকা দেশের অন্য সব বন্দরের ইমিগ্রেশন চালু হলেও এটি এখনও রয়েছে বন্ধ।

ভৌগলিক অবস্থান ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিরল বন্দরের গুরুত্ব স্বীকার করছেন সবাই, কিন্তু তাতে মন্ত্রণালয়ের নেই নজর।

বিদ্যমান জটিলতাগুলো দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে বন্দর চালুর দাবি সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষ্য, বিরল বন্দর চালু হলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রসার, ত্রিদেশীয় পণ্য আমদানি-রপ্তানি ও মানুষ যাতায়াতের রুটসহ নানা সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।

ব্রিটিশ আমল থেকে দিনাজপুরের বিরল হয়ে ভারত ও নেপালের রেলপথে পণ্য আনা নেওয়া হতো। ২০০৫ সালে ভারতীয় অংশের রেললাইন ব্রডগেজে রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।

পরে ত্রিদেশীয় পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের সুবিধায় ১ হাজার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অংশের মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হয়।

২০১৭ সালে ভারত থেকে ট্রেনে মালামাল আসা শুরু হয়। এখনও ট্রেনে কিছু পণ্য এলেও বন্দরের পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় ২০০৬ সালে বিরল স্থলবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পায় বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

জমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতা পার করে বিভিন্ন অবকাঠামো ও সড়ক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে চুক্তির পর দীর্ঘ ১৮ বছর গড়ালেও পুরোপুরি চালু হয়নি বন্দরটি।

অথচ বিরল স্থলবন্দর পুরোপুরি চালু হলে পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচ যেমন কমত, তেমনি যাত্রী-ব্যবসায়ীদের সময় ও খরচও বাঁচত। 

বন্দর সুনসান

দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বিরল স্থলবন্দর। বন্দরের বাংলাদেশ অংশে রয়েছে দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলা এবং ভারত অংশে রয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলার রাধিকাপুর।

বাংলাদেশে বিরলই একমাত্র বন্দর, যার সঙ্গে ভারতের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।

স্বাধীনতার আগে এবং পরে বিরল বন্দরে ইমিগ্রেশন চালু ছিল। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির সময় বন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা হয়। পরে অন্য সব বন্দর চালু হলেও এটি আর চালু করা হয়নি।

এক সময় যে স্থান পাসপোর্ট, ভিসা ও ইমিগ্রেশনের কাজে ব্যস্ত থাকত, এখন তা পড়ে আছে বিরান অবস্থায়।

বিরল স্থলবন্দরের ভবনের সামনে স্থানীয় বাসিন্দা মোবারক ও তার স্ত্রীকে খড় শুকাতে দেখা যায়। মোবারক জানান, এই বন্দর এক সময় ছিল অনেকের রুটি-রুজির জায়গা।

“এই আধিকাপুর (রাধিকাপুর) বর্ডার চালু আছিল। পাসপোর্ট দিয়া মানুষ যাইত-আসত। করোনায় বন্ধ আছিল। তারপর থাকি আর চালু হয় নাই। এটা চালু হইলে ভালো হয়।” 

বিরল স্থলবন্দর চালু হলে কী সুবিধা- এ প্রশ্নে মোবারক বলেন, “দেখো দি, এলাকার উন্নয়ন মানে, একটা আলো আইসবে, সুন্দর হবে, ভালো হবে।”

মোবারকের স্ত্রী নার্গিসও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলেন, “এই বন্দর আবার চালু হইলে মানুষের অনেক কাজ কাম হইবে।”

ধান মাড়াইয়ের কাজ করে ক্লান্ত এক যুবক স্থলবন্দরের একতলা ভবনে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, “কাস্টমের অফিস তইরি হয়ি আছে, কিন্তু অফিসাররা আসতেছে না।”

দিনাজপুর শহরের বাসিন্দা বাপ্পী চন্দ্রশীল; চিকিৎসাসহ নানা কারণে প্রায়ই তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের ভারতে যেতে হয়। বিরল-রাধিকাপুর চালু থাকার সময় ভারতে যাতায়াতে অনেক সুবিধা হতো। শহর থেকে এটি অনেক কাছে।

তাছাড়া এ পথে ভারতের রাধিকাপুর থেকে দেশটির যে কোনও জায়গায় সড়ক ও রেলপথ দু’পথেই যাতায়াত সহজ।

এখন বাপ্পী চন্দ্রশীলের মতো অনেক বাংলাদেশিকে হিলি, বাংলাবান্ধাসহ অন্য বন্দর দিয়ে ঘুরপথে ভারতে যেতে হয়। এতে টাকা খরচ যেমন বেশি হয়, তেমনি ঝক্কি-ঝামেলাও কম পোহাতে হয় না।

বিরল বন্দরের রেল স্টেশনটিও অলস পড়ে আছে। অথচ স্থলবন্দর চালু থাকা অবস্থায় কর্মমুখর থাকত এই স্টেশন।

বাংলাদেশের শেষ প্রান্তের এই স্টেশনে এখন সুনসান নীরবতা। স্থানীয়রা জানান, সারা দিনে মাত্র একটি কমিউটার ট্রেন একবার আসে যাত্রী আনা-নেওয়ার জন্য। সে ট্রেনেও যাত্রী থাকে না বললেই চলে। স্থলবন্দর চালু থাকার সময় বেশ সরগরম ছিল ওই এলাকা।

স্থানীয়রা জানান, ভারত থেকে মাঝেমধ্যে পণ্যবাহী কিছু ট্রেন এই স্টেশন অতিক্রম করে যায়। এসব ট্রেনে পাথর, কয়লাসহ অন্যান্য পণ্য থাকে।

৩ জটিলতা

তিন খাতে জটিলতার কারণে বিরল বন্দর আলোর মুখ দেখছে না বলে মনে করেন বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী। 

প্রথম জটিলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “এখানে রাধিকাপুর পোর্টের তিনটি অংশ। একটা অংশ হলো ইমিগ্রেশন ভিসা, যা করোনার আগ পর্যন্ত রানিং ছিল। করোনায় বাংলাদেশের সব পোর্ট ভারতে বন্ধ হলো। এরপর বাংলাবান্ধা পোর্ট খুলে গেছে, হিলি খুলে গেছে। কিন্তু বিরল খুলল না।

“কিছুদিন আগে ভারতীয় হাইকমিশনার যিনি রাজশাহীর দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি এখানে এসে ঘুরে গেলেন। আমরা তাকে বলেছি, সরকারি পর্যায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, যেমন স্থানীয় এমপি খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তারা যদি গুরুত্ব দেন, তাহলে ভিসা চালু হয়ে যাবে।

“এটা গেল একটা। দ্বিতীয় জটিলতা হলো, এখানে রেলের আমদানি-রপ্তানি চালু আছে কিন্তু তাতে বিরলবাসী তথা দিনাজপুরবাসীর কোনও সুফল নেই। কারণ বাংলাদেশ অংশে মূল রেললাইনের পাশে লাইন স্থাপনের কথা। সেটি রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আজও হয়নি। এ কারণে এটি স্থবির পড়ে আছে।”

রেলপথে দু’দেশের আমদানি-রপ্তানি চালু থাকা সত্ত্বেও এই বন্দর নিয়ে মানুষের আগ্রহ না থাকার কারণ হিসেবে সহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, “এখানে পণ্য লোড-আনলোডের কোনও ব্যবস্থা নেই। এখন রেল অধিদপ্তর মূল রেললাইনের পাশে লাইন বসানোর কাজ যত তাড়াতাড়ি শুরু করবে, তত তাড়াতাড়ি এটা চালু হবে।”

শেষ জটিলতা সম্পর্কে বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের এই কর্মকর্তা বলেন, “সড়কপথে আমদানি-রপ্তানি ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে আছে। দুই দেশেই রোড করা আছে, কিন্তু সড়কপথ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়নি। রেলপথের যে চুক্তি আছে, সেটার সঙ্গে সড়কপথের কথাটা লেখা নেই।

“রেলপথের চুক্তিতে যদি সেটা সংযোজন করা হয় বা নতুন চুক্তি করা হয়, তাহলে সড়কপথে আমদানি-রপ্তানি চালু হয়ে যাবে। কারণ সড়কপথে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার গেজেট প্রকাশ করেছে এবং স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণাও দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চুক্তি না থাকার কারণে ভারত থেকে কিছু পাচ্ছে না। এই তিন সেক্টরে এই তিন জট লেগে থাকায় বিরল স্থলবন্দর দাঁড়াতে পারছে না।”

বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহিদুর রহমান পাটোয়ারী।

বিরল বন্দরের সম্ভাবনা

বিরল বন্দরের নানা সুযোগ-সুবিধা ও গুরুত্ব তুলে ধরে বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সহিদুর বলেন, “কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, মানুষের যাতায়াতের দিকটাও যদি দেখি, তাহলেও এই পোর্টটি দেশের হাতেগোনা কয়েকটি পোর্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

“কারণ বিরল বন্দর জেলা শহরের সঙ্গে লাগোয়া। মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা। বাংলাদেশের অন্য বন্দরগুলো শহরের এত কাছে না। জেলা শহর কাছে হওয়ায় আবাসিক সুবিধা, যাতায়াত সুবিধা, ব্যাংক সুবিধা সবই যাত্রী আর ব্যবসায়ীদের হাতের নাগালে।

“বিরল উল্লেখযোগ্য বন্দর হওয়ার আরেক কারণ হলো, এর মাধ্যমে সড়ক আর রেলপথে বৈদেশিক বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি সম্ভব। পণ্য রেলে এসে ট্রাকে লোড হবে। ট্রাকে এসে রেলে লোড হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রেও ট্রাকে নিয়ে এসে রেলে রপ্তানি হবে। রেলে এসে ট্রাকে রপ্তানি হবে।

“শেষ উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, শুধু ভারত নয়, বিরল স্থলবন্দরের সঙ্গে নেপালেরও সংযোগ আছে। আমার নিজেরও বহু মালামাল নেপাল থেকে এই রুটে রেলপথে এসেছে। এর মাধ্যমে ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ত্রিদেশীয় বাণিজ্য ও যাতায়াত খুবই সম্ভব।”

“সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপি, দিনাজপুরের মানুষ, ব্যবসায়ী বা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সবার জন্য এটা দুঃখজনক যে, এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিরল স্থলবন্দরকে আলোর মুখ দেখানো যাচ্ছে না ১৮ বছর ধরে,” আক্ষেপ করে বলেন সহিদুর।

বিরল ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অভিযোগ, মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার বিষয়গুলো তোলা হলেও কোনও অগ্রগতি নেই।

খুব সহজে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সব স্থবির হয়ে আছে, মন্তব্য তার।

এ বিষয়ে এলাকার সংসদ সদস্য ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সহকারী একান্ত সচিব আ ন ম আহমাদুল বাশারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিরল-রাধিকাপুর বন্দর নিয়ে প্রতিমন্ত্রী এই মুহূর্তে কিছু বলতে রাজি নন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত