রমজান হিজরি ক্যালেন্ডারের নবম মাস। মুসলমানদের কাছে মাসটি সংযমের। এই মাসের প্রতিদিন ভোর রাতে খাবার খাওয়ার পর থেকে উপবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রোজা, যা সূর্যাস্তের সময় খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে ভাঙা হয়। মাগরিবের নামাজের পর বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে, বাড়িতে ও মসজিদে ইফতার খাওয়া হয়। রমজান মাসে মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করেন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে এই মাসে একটি খাবার সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয়, তা হলো বিরিয়ানি।
সুগন্ধিযুক্ত এক-পাত্রের এই খাবার ভাতের সঙ্গে মাংস (মুরগি, গরুর মাংস, ছাগল-খাসি, ভেড়ার মাংস, চিংড়ি বা মাছ) এবং সুগন্ধি মশলা মিশিয়ে তৈরি করা হয়। অতীতে বিরিয়ানি ছিলো রাজদের খাবার। কিন্তু এখন তা সব ভারতীয়দের খাবারে পরিণত হয়েছে।
কলকাতার মনজিলাত রেস্তোরাঁর মালিক মনজিলাত ফাতিমা বলেন, “বিরিয়ানি হলো এক পাত্রের খাবার, যার জন্য হয়ত একটি পুদিনা রাইতা (দইয়ের সঙ্গে সবজি, পুদিনা ও মশলা দিয়ে বানানো একটি চাটনিজাতীয় খাবার বা মশলা দই) ছাড়া আর কোনও সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। এটি সারা বছর ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং বিশেষ করে রমজানের সময় বেশি জনপ্রিয়। কারণ রমজানে আমরা রান্না, খাওয়া ও হজমের জন্য সুবিধাজনক এবং সারাদিন ধরে উপবাসের সময় শক্তির জোগান দেবে এমন খাবার চাই।”
মনজিলাত ফাতিমা আইনজীবী থেকে শেফ বা রাধুঁনী হয়েছেন। তিনি উত্তর ভারতের আওয়াধ বা অযোধ্যার রাজ পরিবারের বংশধর।
ভারতে বিরিয়ানির ইতিহাস কয়েক শতাব্দী পুরোনো। ২০১৭ সালে প্রতিভা করণ তার রান্নার বই বিরিয়ানিতে লিখেছেন, ভারতে বিরিয়ানি এসেছে ১৬ শতকে মুঘল শাসকদের হাত ধরে। তবে এর উৎপত্তি হয়েছে পারস্যে (ইরানে)। ভাতকে ফারসি ভাষায় বলা হয় বিরিঞ্জ। আর বিরিঞ্জ থেকেই বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে।
এই খাবারে জাফরানের মতো ব্যয়বহুল ও দুষ্প্রাপ্য উপাদানের ব্যবহার থেকে ধারণা করা হয়, বিরিয়ানি ছিল রাজাদের খাবার। পারস্য থেকে বিরিয়ানি আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গলদের রাজত্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেই এটি মুঘলদের হাত ধরে ভারতে আসে।
আরেকটি কিংবদন্তিতে মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলকে এই খাবার প্রচলনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। যার স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৭ শতকে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। বলা হয়, একবার সেনা ব্যারাক পরিদর্শনের সময় সৈন্যদের অপুষ্টি দেখে তিনি বাবুর্চিকে সুষম পুষ্টির জোগান দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ খাবার তৈরি করতে বলেছিলেন। আর সেখান থেকেই বিরিয়ানির জন্ম হয়েছিল। যাইহোক, তবে এটি একটি স্থানীয় লোককথা বলেই মনে হয়। বিশ্বের খাদ্য গবেষকরা একমত, বিরিয়ানির উদ্ভব প্রাচীন পারস্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের হালা’স দস্তরখান নামে বিরিয়ানি ও কাবাবের ক্যাটারিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হালা পারভেজ বলেন, “বিরিয়ানি নামটি মূল ফার্সি শব্দ বিরিঞ্জ বিরিয়ানি থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ ফ্রাইড রাইস বা ভাজা ভাত। ভারতীয় উপমহাদেশ সমৃদ্ধ খাবারটিকে নিজের করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়। ভারতে প্রায় ৫০০ ধরনের বিরিয়ানি রয়েছে।”
বিরিয়ানি রান্না করার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নিতে হয়, সেজন্যই হয়ত এই নামকরণ।
মুঘলরা এর রান্নার কৌশল ও উপাদানগুলো চালু করেছিল, যা এখন বিরিয়ানির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেমন, জাফরান, যা বিরিয়ানিকে এর স্বতন্ত্র হলুদ রঙ ও সুগন্ধ দেয়; আর দই, যা মাংসকে নরম করে ও রসালো স্বাদ এনে দেয়। বিরিয়ানি রান্নার অনন্য কৌশলটিও প্রবর্তন করেন মুঘলরা। একটি মুখ বন্ধ পাত্রে ভাত ও মাংস অল্প আগুনে ধীরে ধীরে সেদ্ধ করে রান্না করতে হয় বিরিয়ানি।
১৮ শতকের মধ্যে অযোধ্যা ও হায়দ্রাবাদ রাজ্যের রাজকীয় রান্নাঘরে বিরিয়ানি রান্নার পদ্ধতি আরও নিখুঁত এবং উন্নত হয়। বাকি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় রসনার পছন্দ ও প্রাপ্যতার উপর নির্ভর করে এর সঙ্গে বিভিন্ন উপাদান যুক্ত হয়েছিল।
আওয়াধি বিরিয়ানি সারা ভারতের বিরিয়ানির সবচেয়ে জনপ্রিয় ধরনগুলোর মধ্যে একটি। কলকাতার মনজিলাত ফাতিমা বলেন, “১৭৮৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আওয়াধের নবাব আসাফ উদ দৌলা আসাফি ইমামবাড়া (লখনউতে একটি মুসলিম মাজার) নির্মাণের ঘোষণা দেন। এর ২০,০০০ শ্রমিককে বিরিয়ানির মতো পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয় দীর্ঘসময় ধরে কাজ করার জন্য।”
একবার নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে এসে নবাব বিরিয়ানির বিশাল কড়াই থেকে আসা সুগন্ধ পেয়ে নিজেও তা চেখে দেখেন। ফাতিমা বলেন, “এরপর বিরিয়ানি রাজকীয় মর্যাদা লাভ করে। রাজার টেবিলের উপযোগী করার জন্য খাবারটির উপাদান থেকে শাকসবজি সরিয়ে ফেলা হয় এবং পদটিকে আরও পরিমার্জিত করে রান্না করা হয়। ক্রিম ও জাফরানের মতো দামি উপাদান যোগ করা হয়।”
কয়েক দশক পরে ১৮৫৬ সালে যখন আওয়াধের দশম নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ব্রিটিশরা লখনউ থেকে নির্বাসিত করার পর তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি মেটিয়াবুরুজে তার প্রাসাদে বাবুর্চিদেরকে বিরিয়ানির সঙ্গে আলু যোগ করে একে আরও ভরাট খাবারে পরিণত করতে বলেছিলেন। আলু তখনও ভারতে এখনকার মতো এতটা জনপ্রিয় হয়নি।
ওয়াজেদ আলি শাহের বেশ অনেক বছর আগেই ইংরেজরা মহীশূরের নবাব টিপু সুলতানকে হত্যা করে তার পুত্র-পরিবারকে কলকাতায় নির্বাসিত করেছিল। ওই পরিবারের মধ্যেও বিরিয়ানি খাওয়ার চল ছিল এবং এখনও কলকাতার টিপু সুলতানের পরিবারের পক্ষ থেকে বিরিয়ানি-উৎসব করা হয়, যেখানে সব রকমের বিরিয়ানি পাওয়া যায়।
আজ এই খাবারটি ভারতে সারা বছর ধরেই জনপ্রিয়। অনলাইন ফুড-ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম সুইগি জানিয়েছে, টানা আট বছর ধরে কোম্পানিটির সবচেয়ে বেশি অর্ডার করা খাবার ছিল বিরিয়ানি। ২০২৩ সালে সুইগির সাইটে প্রতি মিনিটে ১৫০টি বিরিয়ানির অর্ডার এসেছিল।
হালা পারভেজ মনে করেন বিরিয়ানির জনপ্রিয়তার একটি কারণ আছে, বিশেষ করে রমজান মাসে। তিনি বলেন, “এটি এমন একটি সময় যখন কেউ এমন কিছু রান্না করতে এবং পরিবেশন করতে চায় যা পছন্দসই, তৃপ্তিদায়ক এবং সব ধরনের রসনাকে তৃপ্ত করে। এজন্য ঝামেলা-মুক্ত বিরিয়ানি সবচেয়ে জনপ্রিয় পছন্দ।”
প্রাচীন ভারতেও পলান্ন নামে একটি খাবার প্রচলিত ছিল। মাংস সহযোগে রান্না করা ভাতকে বলা হতো পলান্ন। সেটিও অনেকটা বিরিয়ানির মতোই ছিল। মহাভারতেও খাবারটির উল্লেখ আছে। মহাভারতের কোথাও ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে এই পলান্ন খাওয়ার কথা বলেছেন, আবার কোনও জায়গায় দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরাও এই পদ খেতেন।
কী এই পলান্ন? এই শব্দটির সংস্কৃত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পল শব্দের অর্থ মাংস এবং অন্ন শব্দের অর্থ ভাত। অর্থাৎ মাংস মিশ্রিত ভাতকেই পলান্ন বলা হত। দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে তামিল অঞ্চলে দ্বিতীয় শতকে ভাতের সঙ্গে মাংস মিশিয়ে ঘি ও মশলা সহযোগে রান্নার প্রচলন ছিল।
কিন্তু কেউ কেউ আবার বলছেন, মুঘল যুগেরও আগে চতুর্দশ শতকের একেবারে শেষ ভাগে ১৩৯৮ সালে তুর্কি-মোঙ্গল সেনাপতি তৈমুর লং যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন এই খাবার ভারতে আসে। তৈমুরের সেনাদলের জন্য পুষ্টিকর অথচ চটজলদি তৈরি করা যায় এমন খাবার হিসেবে ভাতের সঙ্গে মাংস ও মসলা মিশিয়ে এক রকমের খাবার তৈরি করা হতো, যা পুষ্টিকর তো বটেই এবং তৈরি করতেও বেশি সময় লাগে না। রান্নার পদ্ধতিও ছিল অভিনব। চাল, বিভিন্ন মসলা ও মাংস একটি হাঁড়িতে ভরে গনগনে গরম একটা গর্তে হাঁড়িটি চাপা দিয়ে রান্না করা হতো এই খাবার।
মনজিলাত ফাতিমার আওয়াধি বিরিয়ানির রেসিপি
উপাদান:
৫০০ গ্রাম লম্বা চিকন চাল
৫টি লবঙ্গ
৫টি এলাচ
২টি জয়ত্রী গদা
১০ গ্রাম দারুচিনি
২০০ গ্রাম ঘি
২ টেবিল চামচ পরিশুদ্ধ তেল
৫০ গ্রাম পেঁয়াজ কুচি
২৫ গ্রাম আদা বাটা
২৫ গ্রাম রসুন বাটা
১ কেজি খাসির মাংস
১২৫ গ্রাম দই, ফেটানো
১ টেবিল চামচ হুলদ গুড়া
লবণ, স্বাদের জন্য
৩-৪ টা তেজপাতা
অর্ধেকটা লেবু
১ টেবিল চামচ জাফরান
১ টেবিল চামচ কেওড়া জল
পদ্ধতি:
ধাপ ১
চাল ধুয়ে এক ঘণ্টার বেশি ভিজিয়ে রাখুন। অর্ধেক মশলা (লবঙ্গ, এলাচ, জয়ত্রী গদা, দারুচিনি) পিষে গুড়া করুন। বাকি অর্ধেক আস্ত রাখনু।
ধাপ ২
একটি পুরু-তলযুক্ত ফ্রাইং প্যানে তেল গরম করুন। পেঁয়াজ তেলে দিয়ে বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন, এরপর প্যান থেকে সরিয়ে রাখুন। একই তেলে অগলিত ঘি, আস্ত মশলা, আদা ও রসুন দিন। খাসির মাংসের টুকরাগুলোও দিন। ভালোভাবে ভাজা হওয়া পর্যন্ত মাঝারি আঁচে ভাজুন। এরপর ফেটানো দই, হলুদ-মরিচ গুঁড়ো এবং লবণ যোগ করুন। ৩ থেকে ৪ কাপ পানি দিয়ে মাংস প্রায় রান্না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সিদ্ধ করুন। মাংস আলাদা করে মসলা ও তেলের স্টক ছেঁকে নিন। একপাশে রাখুন।
ধাপ ৩
আরেকটি মোটা-তলাযুক্ত ফ্রাইং প্যানে তেজপাতা, গুড়া লবঙ্গ ও এলাচ দিয়ে প্রায় ৫ কাপ পানি ফুটিয়ে নিন। পানি ফুটে উঠলে স্বাদমতো লবণ দিন এবং লেবুর রস চেপে নিন। জ্বালের আগুন বাড়িয়ে রেখে পানি ঝরানো চাল যোগ করুন। ৮ থেকে ১০ মিনিটের জন্য ঢাকনা ছাড়া রান্না করুন, চালটা চারভাগের তিনভাগ সেদ্ধ করুন। এরপর ভাত ছেকে নিন।
ধাপ ৪
অপর ফ্রাইং প্যানটিতে খাসির মাংসের ওপর রান্না করা ভাত আলতো করে ছড়িয়ে দিন এবং এর উপর মাংস থেকে আলাদা করা মসলা ও তেলের স্টক ছিটিয়ে দিন। একটি পাত্রে জাফরান ও কেওড়া জলের সাথে ময়দা ও দারুচিনি মিশিয়ে চালের উপর ছিটিয়ে দিন। মিশ্রণের উপর ২ টেবিল চামচ গলিত ঘি ছড়িয়ে দিন। একটি ঢাকনা দিয়ে প্যানটি ঢেকে রাখুন এবং একটি ভারী জিনিস দিয়ে উপরে চাপা দিয়ে রাখুন যাতে বাষ্প বেরিয়ে না যায়। ১৫-২০ মিনিটের জন্য সিদ্ধ করুন, বা যতক্ষণ না চাল সম্পূর্ণ সেদ্ধ হয় এবং সমস্ত কিছুর ফ্লেভার বের হয়। পরিবেশনের আগে ভালো করে মিশিয়ে নিন।
হাড় থেকে ছাড়ানো মাংস খুব ভালোভাবে সেদ্ধ করে নরম করার পর লম্বা দানার চাল দিয়ে রান্না করলে বিরিয়ানি সবচেয়ে সুস্বাদু হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এই সময়