টাইফয়েডে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র চার বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারান ফেনীর ফুলগাজীর মোশাররফ হোসেন মজুমদার। জীবনের আলো ফোটার আগেই যখন চোখের আলো হারিয়ে যায় তার, তখন তার বাবা তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলের ভবিষ্যৎ গড়তে হলে শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই; সেই ভাবনা থেকে সচেতন এ বাবা ছেলেকে বাড়িতে বসিয়ে না রেখে ৭ বছর বয়সে দৃষ্টিহীনদের বিশেষ এক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।
বাবার অনুপ্রেরণায় সেই মোশাররফ হোসেন মজুমদার স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮৩ সালে আইন পেশায় যুক্ত হন। তিনি এখন সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
মোশাররফ একজন দৃষ্টিহীন হয়েও কীভাবে সর্বোচ্চ আদালতের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হতে পেরেছেন? চোখে না দেখেও কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছেন? পেশাগত ক্ষেত্রে কীভাবে সামলে ওঠেছেন?
বিশ্ব দৃষ্টি দিবস ধরে সকাল-সন্ধ্যার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন মোশাররফ মজুমদার।
দৃষ্টিহীন ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রতি বছর অক্টোবরের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পালিত হয় বিশ্ব দৃষ্টি দিবস। সেই হিসাবে এবার ১০ অক্টোবর পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে- ‘শিশুরা, ভালোবাস তোমাদের চোখকে’।
শৈশবে দৃষ্টি হারানো মোশাররফ হোসেন মজুমদার নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন সচেতন একজন বাবা পাওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, “দৃষ্টি হারিয়েও আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম এটাই যে, আমার বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন, অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। উনি আমাকে যথাসময়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলে ভর্তি করান। তখন আমার বয়স ৭ বছর। আমি লেখাপড়া করার জন্য উপযুক্ত সময়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি।”
ফেনী, ঢাকা ও বরিশালের তিনটি বিশেষ স্কুলে পড়াশোনা শেষে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করেন মোশাররফ। এরপর ১৯৭৭ সালে বরিশালের সরকারি বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
এইচএসসি পাসের পর মোশাররফ আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেজন্য প্রবল ইচ্ছা শক্তির পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।
আইনজীবী হওয়ার পেছনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “কলেজ থেকে বের হয়ে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা থেকেই আমি ভাবতে থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে আমাকে ভর্তি হতে হবে। এজন্য আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে।
“আমি যেহেতু দৃষ্টিহীন, সেজন্য আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করি। কারণ ব্রেইল পদ্ধতি সম্পর্কে তখন ততটা পরিচিত ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সিনিয়র শিক্ষকদেরকে জানাই যে আমি ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছি এবং পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে আমি শ্রুতি লেখককে সঙ্গে নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও যেন ব্রেইল পদ্ধতিতে অংশ নিতে পারি, সেই সুযোগ চাই। দৃষ্টিহীনতার কারণে যেন আমি বাদ না পড়ি।”
এরপর আইন বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান তাকে ব্রেইল পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মোশাররফ। আইন বিভাগে চার বছরের স্নাতক এবং এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ফলাফলেও প্রথম ১০ জনের মধ্যে ছিলেন।
আইন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে অ্যাডভোকেট হিসাবে সনদ পাওয়ার পর পেশাগত জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না মোশাররফের। দৃষ্টিহীন হওয়ার কারণে নানা বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।
মোশাররফ বলেন, “১৯৮৩ সালে বার কাউন্সিলে পরীক্ষা দিয়ে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হই। কিন্তু এখানে কাজটা তো এত সহজ না। আইন ব্যবসায় একজন ক্লায়েন্ট যখন আমাকে আইনজীবী হিসেবে মনোনীত করবেন, তখনই আমি কাজটা করতে পারব। সেখানে দৃষ্টিহীনতার কারণে আমার জন্য একটা বড় বাধা ছিল।
“দ্বিতীয়ত হলো, আমাদের সমাজে একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে পেশার ক্ষেত্রে, এখনও যথেষ্ট বিদ্যমান আছে। চাকরি বলেন, ব্যবসা বলেন, সেখানে মানুষের মধ্যে এখনও দৃষ্টিহীন যারা তারা পারবে কি পারবে না, এমন নেতিবাচতক ধারণা আছে।”
এই বাধা কীভাবে উৎরালেন? উত্তরে মোশাররফ বলেন, “আমি যেটি করেছিলাম, প্রথম দিকে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে বিনামূল্যে মামলা নিয়ে কাজটা করতাম। প্রথম দিকটা এভাবেই আমি শুরু করি।”
আইন পেশায় কাজ শুরু করলেও কাঙ্ক্ষিত উপার্জন না হওয়ায় তখন ঢাকায় একটি আইন কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি।
“সেখানে একটি সাবজেক্ট পড়াতাম, কিন্তু বহু শিক্ষার্থী আমার কাছে স্বেচ্ছায় পড়ত। তারা সব সাবজেক্টই পড়ত। সেখান থেকে আমার একটা আয় হতো। ওই ইনকাম যদি না হতো, তাহলে আমি আইন পেশায় টিকে থাকতে পারতাম না।”
আইন পেশায় পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে এ বাধা-বিঘ্ন এখনও দূর হয়নি, তবে আগের তুলনায় কমেছে বলে মনে করেন মোশাররফ।
তিনি বলেন, “সব দিকে থেকে সুস্থ সবল একজন আইনজীবী যেমনভাবে ফিস নেন, আমরা কিন্তু সেভাবে নিতে পারি না। আমরা তুলনামূলকভাবে ফিস একটু কম নিয়ে থাকি।
“মানুষের উপকার যতটুকু করা যায়, সেই চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যারা ক্লায়েন্ট তারা অনেক সচেতন হয়েছেন। এখন অনেকে স্বেচ্ছায় নিজে থেকেই আমার কাছে আসছেন।”
মোশাররফ হোসেন ১৯৮৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টে বিভাগে এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন। গত ২ অক্টোবর তিনি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
সর্বোচ্চ আদালতে লড়তে মামলা শুনানির ক্ষেত্রে অন্যান্য সুস্থ-সবল আইনজীবীদের মতো করেই আদালতকে আইন-বিধি, রেফারেন্স দিয়ে বোঝাতে হয়।
মোশারফ বলেন, “এক্ষেত্রে আমি যেটা করি, নিজেও ব্রেইল করে কোর্টকে পড়ে শোনাই। আবার অনেক সময় বেশি পড়তে হয় না, সেটা আদালতে সাবমিট করলেই চলে। এরপরও যদি বিচারক শুনতে চান, তাহলে আমার সঙ্গে সহযোগীরা থাকেন, জুনিয়রদের মাধ্যমে পড়ে শোনাই। কখনও কখনও মেইন বিষয়টি আমি বললে পরবর্তী বিষয়গুলো কোর্ট বুঝে নেন। এভাবে কোর্টকে আমি বোঝাতে পারি।”
ব্যক্তি জীবনে মোশাররফ হোসেন দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তার স্ত্রী একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। দুই মেয়েও এখন কলেজ শিক্ষক। ছেলে স্থাপত্য বিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে এখন উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করছেন।
৪১ বছর ধরে আইন পেশায় থাকা মোশাররফের সঙ্গে দৃষ্টিহীন বেশ কয়েকজন জুনিয়র আইনজীবী কাজ করেছেন।
মোশাররফ জানান, সারাদেশে বিভিন্ন আদালতে এখন প্রায় ৪০ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আইনজীবী কাজ করছেন। অন্যান্য প্রতিবন্ধীও আছেন।
“আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, মানুষের ভেতর বিশ্বাস সৃষ্টি করা। তারা যেন আমার ওপর নির্ভর করতে পারে, সেই আত্মবিশ্বাস তৈরি করা। সেই ধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি না করতে পারলে তো আমার কাছে আসবে না।”
সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে প্রতিবন্ধী বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি এবং অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেন মোশাররফ।
“অস্বচ্ছল মানুষ, যারা অর্থের অভাবে মামলা করতে পারছে না, যে মামলার গুণাগুণ আছে, সেগুলোর জন্য নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্য পরিচালনা করব। বহু মানুষ এখনও অধিকার বঞ্চিত আছে, এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আগে থেকেই লড়াই করে আসছি। এখন একজন সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে প্রতিবন্ধীসহ সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
ভবিষ্যতে আইন পেশাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কীভাবে আরও সহজ করা যায় এবং একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে সব ধরনের কাজ করতে পারে এবং মানুষের উপকারে আসতে পারে, সমাজের মূল স্রোতধারায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে এবং কল্যাণে কাজ করতে পারে সেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা করণীয় তা করতে চেষ্টা করে যাবেন বলে জানান এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “অনেকগুলো চাকরি এখনও প্রতিবন্ধী মানুষরা পাচ্ছে না। যেমন আইন কর্মকর্তা হিসাবে প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়োগ পাচ্ছেন না। ডিএজি, এএজি, এসব ক্ষেত্রে যেন প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাব।
“এছাড়া আমাদের জন্য একটি আইন আছে, সেটা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন- ২০১৩। এ আইনটি বাস্তবায়নে, তাদের সমস্যা সমাধানে যা করার আমি চেষ্টা করব।”