‘বাংলাদেশ নালিশ পার্টি’- গত দেড় দশকে এমন কথা যে কতবার শুনতে হয়েছে বিএনপি, তার ইয়ত্যা নেই। কেন বলতেন, তার ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দিতেন এভাবে- তারা কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিয়ে কেবল আওয়ামী লীগের নামে নালিশ করে বেড়ায়।
২০০৯ সালের ক্ষমতায় বসা আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনকালে বিভিন্ন সময়েই কূটনীতিকদের কাছে যেতে দেখা গেছে বিএনপির নেতাদের। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট গেছে পাল্টে। এখন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা যাচ্ছেন বিএনপির কার্যালয়ে।
এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করলেও রাজনীতির মঞ্চে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির মধ্যে বিএনপির গুরুত্ব যে বেড়েছে, তা স্পষ্ট। চীনের রাষ্ট্রদূত গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনেও আসেন।
আগে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি অভিযোগ থাকত নির্বাচনে জালিয়াতি, গণতন্ত্রহীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব এমন সব বিষয় নিয়ে।
এখন বিএনপি ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিপক্ষ নয়। সেক্ষেত্রে কী নিয়ে আলোচনা হয়?
দলটির নেতারা বলছেন, সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করতে চায় বিএনপি, সেই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক কমিটিতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যেভাবে বিএনপিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল, কূটনীতিকদের ওপরও অনেকটা তেমন প্রভাব ছিল।
“আজ বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। কূটনীতিকরাও সেটা বুঝতে পারছে। আর তারই রূপ দেখতে পাচ্ছেন আপনারা (সাংবাদিকরা)।”
আগে কী আলাপ হতো?
তিন বার সরকারে থাকা বিএনপি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ক্ষমতার বাইরে। ফলে এই সময়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে তাদের আলোচনায় নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেত।
গত বছরের ২ আগস্ট ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদেরসঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বৈঠক করে বিএনপির নেতারা।
বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে নানারকম তল্লাশি, পরদিন শনিবার ঢাকার প্রবেশ মুখে অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও সরকারি দলের হামলা, গুলিবর্ষণ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে কূটনীতিকদের বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
ওই দিন বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল, ২৫টি দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। আসলে নয়টি দেশের প্রতিনিধি ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে সবাই কূটনীতিকও ছিলেন না।
পরবর্তীকালে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরাল করতে গত ১৪ আগস্ট বিএনপি একটি সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। ওই সেমিনারেও বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এই দুটি অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। ২ আগস্টের কূটনীতিকদের ব্রিফিংকে বিএনপি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিল। এ জন্য দলের স্থায়ী কমিটির ছয়জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেই বিবেচনায় কূটনীতিকদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। সেখানেও অভিযোগ করা হয়েছিল, কীভাবে সরকার সেই সমাবেশে বাধা দিয়েছে। পুলিশ দিয়ে হামলা চালিয়েছে ইত্যাদি।
এ কথায় বলতে গেলে, গত দেড় দশকে বিএনপি নেতারা অভিযোগের ডালি নিয়েই দেখা করতে যেতেন বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে।
এখন কি আলাপ হয়?
গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ধাপে ধাপে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করছে বিদেশি কূটনীতিকরা। গুলশান চেয়ারপার্সন কার্যালয়েই হচ্ছে বেশিরভাগ বৈঠক।
গত ৪ সেপ্টেম্বর গুলশানে ফিরোজায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসভবনেও গিয়েছিলেন ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুক।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মূলত খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতেই এসেছিলেন সারাহ কুক। পাশাপাশি তিন বারের প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয়ে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা যান বিএনপির গুলশানের কার্যালয়ে; সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের আলোচনা হয়। পাস্পরিক সম্পর্ক আরও গভীর ও দৃঢ় কীভাবে করা যায়, সে বিষয়েও কথা বলেরন তারা।
তার দুদিন পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক।
সাক্ষাতের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, “কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ, এগুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।”
গত ৬ অক্টোবর বিএনপিরবৈঠক হয় ঢাকায় নিযুক্ত সুইডিশ রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন আরালড গুলব্র্যান্ডসেন ও ডেনিশ দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন অ্যান্ডার্স বি কার্লসেনের সঙ্গে।
দুদিন আগে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেন ঢাকায় নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘনশ্যাম ভান্ডারী।
ওই বৈঠকে সার্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নেপালের হাইড্রোলিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আনার বিষয়ে কথা হয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানান আমীর খসরু।
তবে এই সবকে ছাপিয়ে যায় গত ২১ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের যাওয়া। সেদিন তিনি দেড় ঘণ্টা বৈঠকের পর বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত হন।
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের বড় অংশীদার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সেদিন বলেছিলেন, “চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও বিএনপি একসাথে কাজ করতে চায়। এই সম্পর্ককে আরও নিবিড় ও সুদৃঢ় করে আমরা কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, কূটনীতিকরা তা বুঝতে পেরেই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ঘটাচ্ছে।
সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে?
ক্ষমতায় থাকতে নানা ঘটনায় শক্তিধর একাধিক দেশের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, গত ১৮ বছরে তা মেরামত হয়নি। বরং দু-চারটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শীতল হয়েছে বলে কূটনীতি বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ।
গত বছরের ১৭ মার্চ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের সঙ্গে বৈঠক করেছিল বিএনপি। ওই বৈঠকের আলোচনা নিয়ে আমীর খসরু সাংবাদিকদের যা জানিয়েছিলেন, তানিয়ে দ্বিমত পোষণ করে অসন্তোষ জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, এর পর থেকে ঢাকার জার্মান দূতাবাস বিএনপির কোনও অনুষ্ঠানের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না।
ওই বছরের ৪ জুন জাপানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের পরও তেমন ঘটনা ঘটেছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত জানায় জাপান।
গত বছরের আগস্টে ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই সদস্যের সঙ্গেও বৈঠক করতে গিয়ে বিফল হয়েছিল বিএনপি।
কূটনৈতিক পর্যায়ে কাজ করেন, বিএনপির এমন নেতারা বলেন, প্রতিষ্ঠাকালে চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা অনেক দেশের সঙ্গে বিএনপির আস্থার সম্পর্ক ছিল। এর যতটুকু সুফল বিএনপি নিতে পারত, তা পারছে না বলে দলের বৈঠকেও অসন্তোষ ছিল।
ভারতের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন রয়েছে। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বিএনপির বিভিন্ন নেতাকে ভারতবিরোধী বক্তব্যও দিতে দেখা গেছে।
তবে গত মাসে প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠকের পর ফখরুল বলেছিলেন, পরিবর্তিত বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোও সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বিষয়ে তাদের আলোচনা হয়।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিদেশিরা বিশেষ কোনও দলের সঙ্গে সম্পর্ক দেখায় না। এটা তাদের কৌশল। আমাদের সঙ্গে আলাদা করে কারও খারাপ সম্পর্ক নেই।
“বহির্বিশ্ব এতদিন ধরে দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নানা সুপারিশ করেছেন। সেদিক থেকে বিএনপির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে কূটনীতিকদের আকাঙ্ক্ষার মিল বরাবরই ছিল।”