তখন ২০১৫ সাল; টানা হরতাল-অবরোধ চলছে বিএনপির। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম কারাগারে। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নের মুখে লুকিয়ে থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছিলেন যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
তারই এক পর্যায়ে ১০ মার্চ খবর আসে ঢাকার উত্তরার একটি বাড়ি থেকে সালাহ উদ্দিনকে গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারি কোনও বাহিনী অবশ্য তখন তা স্বীকার করেনি।
দুই মাস পর ভারতের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য মেঘালয়ের শিলংয়ে পাওয়া যায় সালাহ উদ্দিনকে। পরে সেখানে গ্রেপ্তার হন তিনি, ভারতে তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলাও হয়।
সেই মামলায় গত বছর খালাস পেলেও ভারতেই ছিলেন সালাহ উদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পাঁচ দিন পর রবিবার দেশে ফিরেছেন তিনি।
ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে সালাহ উদ্দিনকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সেখানে ছিলেন বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন। সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদও ছিলেন বিমানবন্দরে।
বর্তমানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন ছাদ খোলা গাড়িতে চড়ে মিছিল নিয়ে বিমানবন্দর থেকে যান শেরেবাংলা নগরে, সেখানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি।
এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লি থেকে ঢাকায় আসেন সালাহ উদ্দিন।
এক সময়ের সরকারি কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন।
এরপর চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে নামেন তিনি। ২০০১ সালে তিনি কক্সবাজার থেকে বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর খালেদা জিয়ার সরকারে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সালাহ উদ্দিন অংশ নিতে না পারলে তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নিখোঁজ হওয়ার সময় সালাহ উদ্দিন ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব। ২০১৬ সালে দলের কাউন্সিলে তাকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়।
যেভাবে উধাও
২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেছিল। তার বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালে আবার সরকার পতনের আন্দোলন চলছিল বিএনপির। তখন অজ্ঞাত স্থান থেকে সালাহ উদ্দিনের নামে বিবৃতি আসছিল।
তার মধ্যে ১১ মার্চ সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ দাবি করেন, আগের রাতে ডিবি পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকার উত্তরার একটি বাড়ি থেকে।
স্বামীর সন্ধান দাবিতে নানা স্থানে ধরনা দেন কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ। প্রথমে থানা পুলিশ হাসিনার সাধারণ ডায়েরি নেয়নি। তবে ১৫ মার্চ উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে নিজেই একটি জিডি করেন।
হাসিনা আহমেদ স্বামীর খোঁজ চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়ে স্মারকলিপি দেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাকে জানানো হয় যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, নিখোঁজ সালাহ উদ্দিনের হদিস করতে চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। ডিবি পাঁচ সদস্যের কমিটিও করে।
এম ইলিয়াস আলীসহ কয়েকজনের গুম হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তখন বিএনপি বলেছিল, সালাহ উদ্দিনকেও সেভাবে গুম করেছে সরকার।
তার জবাবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছিলেন, সরকারের উপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে সালাহ উদ্দিন আত্মগোপন করেছেন।
যেভাবে সন্ধান
দেশে যখন সালাহ উদ্দিনের খোঁজ চলছে, তখন ৬৩ দিন পর ২০১৫ সালের ১১ মে সিলেটের ওপারে মেঘালয়ের শিলংয়ের পথে উদভ্রান্ত অবস্থায় সালাহ উদ্দিনকে পাওয়ার কথা জানায় সেখানকার পুলিশ।
উদ্ধারের পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় শিলং পুলিশ। তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, “হ্যাঁ, আমিই বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন। আমাকে উত্তরা থেকে অচেনা একদল লোক তুলে নিয়েছিল। আমি জানি না, আমি কীভাবে এখানে এলাম। অপহরণের পর থেকে আর কিছুই মনে করতে পারছি না।”
তখন প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, সাদা পোশাক পরা সালাহ উদ্দিনের গায়ে জড়ানো রয়েছে একটি খয়েরি-সাদা চেক চাদর। তার হাত ধরে রেখেছেন একজন পুলিশ সদস্য। পেছনে একজন নার্স।
বিএনপি তখন দাবি করেছিল, সালাহ উদ্দিকে ধরে নিয়ে সীমান্তে পার করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
ভারতে প্রবেশ করলেও তার কোনও বৈধ কাগজপত্র সেসময় মেঘালয় পুলিশ না পাওয়ায় ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার দেখায়।
সেই মামলায় ২০১৫ সালের ২২ জুলাই শিলংয়ের আদালতে অভিযোগ গঠন হয়। ওই মামলায় ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর খালাস পান সালাহ উদ্দিন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ভারত সরকার আবার আপিল করে। সেই আপিল নিষ্পত্তি করে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শিলং জজ কোর্ট সালাহ উদ্দিনকে খালাস দেয়। দ্রুত তাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেয় আদালত।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আর দেশে ফেরার চেষ্টা করেননি সালাহ উদ্দিন।