কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতার পর ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সুনসান নীরবতা।
কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান, বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজন নেতা আটক হওয়ার পর গ্রেপ্তারের ভয়ে নয়া পল্টনমুখী হচ্ছে না বিএনপির কর্মীরা।
কারফিউ শিথিল অবস্থায় বৃহস্পতিবার সারাদিনে বিএনপির কোনও নেতা-কর্মীকে কার্যালয়ে দেখা যায়নি। শুক্রবার সকালেও ছিল একই অবস্থা।
কারফিউ শিথিল হওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে নয়া পল্টনের সড়ক ব্যস্ত হয়ে ওঠে মানুষের চলাচলে। সড়কের দুই পাশে গাড়ি চলাচলও ছিল।
তখনও বিএনপির কার্যালয়ের মূল কলাপসিবল গেইটে ঝুলছিল দুটি তালা। উঁকি দিয়ে ভেতরে একটি ফ্যান চলতে দেখা যায়, বাতিগুলোও জ্বলছিল। গেইটের ভেতরে পড়েছিল কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা।
কলাপসিবল গেইটের সঙ্গেই আরেকটি তালা দিয়ে একটি চায়ের টং দোকান বাঁধা অবস্থায় ছিল। যেখানে একটি পোস্টারে লেখা- সকাল ১০ টা থেকে ১১.৩০ পর্যন্ত বিনামূল্যে চা খাবেন, দেশনেত্রীর জন্য দোয়া করবেন।
পথচারীদের কেউ কেউ কৌতূহল ভরে উঁকি দিচ্ছিলেন বিএনপি কার্যালয়ের প্রবেশমুখে। সারাদিন রিকশাচালকদের একটি জটলাও সেখানে ছিল।
সেই জটলায় থাকা জীবন আলী নামে এক রিকশাচালক বলেন, “এখানে চা খাইতে আইলাম, এহনও খুলে নাই। ফ্রি তে খাওয়াইতো।”
বিএনপি কার্যালয়ের পাশের ভবনে পূবালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে। তার নিচে রয়েছে একটি এটিএম বুথ। সেই বুথের পাহারাদার হান্নান মিয়া বলেন, “বিএনপি অফিসে কেউ নাই। শুক্রবার বিকালে যে গ্যাঞ্জাম হলো, তারপর থেকে কেউ আসে নাই।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংঘাতে গড়ানোর পর ৫ দিনেই দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে ঢাকায় হতাহতের সংখ্যা বেশি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করে আসছিলেন, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়ে বলেন, সংঘাতের পরিস্থিতিতে সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
বিএনপি শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সমর্থন দিলেও ভাংচুর-অগ্নিসংযোগে দলের কেউ নেই বলে ফখরুলের দাবি।
আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর গত ১৬ জুলাই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই কার্যালয়ে শতাধিক হাতবোমা, ৫/৬ বোতল পেট্রোল, ৭টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র পাওয়ার দাবিও করেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।
সেদিন বিএনপির কার্যালয় থেকে স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের দুই নেতাসহ সাতজনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
এরপর দলটির কার্যালয় তালাবদ্ধ করে পুলিশ ও চারপাশে ‘ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ ফিতা টানিয়ে দেয়। কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশও পাহারায় বসে।
এরপর গত কয়েকদিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রফিকুল ইসলামসহ অনেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তা হারুন গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় বিএনপি-জামায়াতের দেড়শ জনকে আটকের খবর দিয়েছিলেন। তবে কোন দলের কতজন, তা জানাননি।
১৬ জুলাই েয ‘ক্রাইম সিন’ লেখা টেপ বিএনপির কার্যালয়ে পুলিশ লাগিয়েছিল, তা বৃহস্পতিবার দেখা যায়নি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও পুলিশও ছিল না সেখানে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল ১১টায় ‘ক্রাইম সিন টেপ’ খুলে ফেলে পুলিশ সদস্যরা চলে যায়। তবে তালা ছিল।
পল্টন থানার এসআই নাজমুল হোসেন জানান, শুক্রবার সকালেই বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়।
আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের গুলির প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করতে চেয়েছিল বিএনপি; তবে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। বিকালে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুরানা পল্টন থেকে সরে নয়া পল্টনে এসে অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়। তখন নেতা-কর্মীরা কার্যালয়ের ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল।
সকালে পুলিশ সরে যাওয়ার পর তালা কে দিয়েছিল- এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বিএনপির দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপুর।
তিনি বলেন, “তালা তো পুলিশই দিল প্রথমে। নাটকীয় অভিযান করে ক্রাইম সিন দিয়ে সেটাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিল।”
পুলিশ তো শুক্রবারই চলে গেছে, এখন তালা কে দিয়েছে- প্রশ্নে তাইফুল বলেন, “কে তালা দিয়েছে, তা আমরা জানি না। নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার চলছে। তাই আপাতত কার্যালয়ে যাচ্ছি না।”
তবে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, শুক্রবারের সংঘর্ষের পর বিএনপি নেতা-কর্মীরাই তাদের কার্যালয়ে তালা দিয়েছিল।
পুলিশ মোতায়েন না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি মাঝে-মধ্যেই বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকেও পল্টন থানার একটি টহল গাড়িকে সামনে দিয়ে যেতে দেখা যায়।
এদিকে নয়া পল্টনের কার্যালয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তালাবদ্ধ করে রেখেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “অভিযানের নামে আমাদের অফিস তছনছ করে দিয়েছে। তারা সেটি তালাবদ্ধ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।”
তিনি শুক্রবার এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আড়াল করতে এবং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপকৌশল হিসেবে বিএনপির নির্দোষ নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার কিংবা নেতাকর্মীদের বাসায় না পেয়ে তাদের সন্তান কিংবা বাসার সদস্যদের গ্রেপ্তার ও অশালীন আচরণসহ বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে।”
বিএনপি কিংবা বিরোধী দলের কেউই এই আন্দোলনে জড়িত ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি।