Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

নিস্তেজ বিএনপিতে হতোদ্যম কর্মীরা

আড়াই মাস পর গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের দিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা তালা ভেঙে ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকে। ফাইল ছবি/সকাল সন্ধ্যা
আড়াই মাস পর গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের দিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা তালা ভেঙে ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকে। ফাইল ছবি/সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

নির্বাচন হয়ে গেল, সরকারও গঠন করে ফেলল আওয়ামী লীগ। তারপর সপ্তাহ তো গড়িয়ে গেল, আন্দোলনের কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিএনপির কর্মীরা; বলছেন, নেতাদের কাছ থেকেও কোনো দিক-নির্দেশনা পাচ্ছেন না।

১৭ বছর হয়ে গেল বিএনপি ক্ষমতার বাইরে; আর সেখানে থেকে দেখতে হয়েছে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছে দেশে রাজনীতির মাঠে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ দল আওয়ামী লীগ।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি, দেয় ভোট ঠেকানোর হুমকি। কিছু সহিংস ঘটনা ঘটলেও ভোট আটকায়নি। বিএনপি অবরোধ ডেকে গেলেও কিছু দিন পর ঘোষণা ছাড়াই কর্মসূচি উঠে যায়। 

এরপর ২০১৮ সালে জোট বড় করে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে কারচুপির অভিযোগ তুলে সেই ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে। তারপর বিএনপির জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়া।

এরমধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সমাবেশ ডাকে বিএনপি, যাতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বেশ সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু সমাবেশ শেষে তারা ফেরার সময় জানিয়েছিল হতাশার কথাই।

তার এক বছর বাদে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর বিএনপি আবার চাঙা হয়ে ওঠে। তবে গত ২৮ অক্টোবর সমাবেশের পর আকস্মিকভাবে ডাকে হরতাল। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এরপর হরতাল-অবরোধের ঘেরাটোপেই চলতে থাকে দলটি।

১২ ধাপে ২৪ দিন অবরোধ এবং ৫ ধাপে ৬ দিন হরতাল বিএনপি ডাকলেও তার তোয়াক্কা না করে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। আর ভোট বর্জনকারী বিএনপির কর্মসূচিও নমনীয় হতে থাকে। অবরোধ, হরতাল শেষে গণসংযোগের কর্মসূচিতে যায় দলটি; দেশবাসীকে আহ্বান জানায় ভোট বর্জনের।

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটের হার গতবারের অনেক কম (৪১ শতাংশ) দেখে সেটাকেই নিজেদের জয় দাবি করে দলটি। জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার লিফলেট বিলিতে নামেন নেতারা।

এরমধ্যে আড়াই মাস পর গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের দিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা তালা ভেঙে ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢোকে।

তবে এরপর কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের তেমন আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। গণসংযোগের কর্মসূচি ডাকা হলেও তাতে তেমন সাড়া দিচ্ছে না। কর্মীদের প্রশ্ন, ভোটের পর নিরুত্তাপ এই কর্মসূচি কি আরও পাঁচ বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় মেনে নেওয়া?

হতাশা থেকে ক্ষোভ তৃণমূলে

বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বেশিরভাগ বলছেন, তারা চাইছিলেন জোরাল কর্মসূচি। কিন্তু তেমনটি পাননি। এখন গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। ২৭ হাজার নেতা-কর্মী এখন বন্দি হয়ে আছেন। 

ঢাকার পল্টন থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের শক্ত সমর্থন রয়েছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেই। কর্মসুচি নেই। আর এই দায় দলের নীতি-নির্ধারকদের।”

শক্ত অবস্থানের ভিত্তি কী- প্রশ্নে তিনি ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের জনসভা দেখিয়ে দেন; বলেন, “মানুষ দেখেছে গোলাপবাগে আমাদের জনসমাবেশে সারাদেশ থেকে কী বিপুল পরিমাণ নেতা-কর্মী এসেছিল। কিন্তু সারারাত মাঠে থেকে কোনো কর্মসুচি না পেয়ে হতাশা নিয়ে ফেরত গেছেন সবাই।”

যশোরের মনিরামপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেতারা বলছিলেন, নির্বাচনের পর কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি আসবে। এখন পর্যন্ত সেই কর্মসূচি দেখতে পাচ্ছি না। কেন হচ্ছে না, সেটাও বুঝতে পারছি না।”

নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় নেতা–কর্মীদের অনেকের মন ভেঙে গেছে বলে মনে করেন নরসিংদীর বেলাব থানা বিএনপি নেতা জুবায়ের আহমেদ। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পুলিশের দৌড়ানিতে আজকে আমি এলাকাছাড়া। সিনিয়র নেতাদের ফোন দিই, তারা বলেন ধৈর্য ধরতে। ধৈর্য ধরতে ধরতে তো আবার সরকার হয়ে গেছে। দলের জন্য জীবন দিতে পারি। কিন্তু জীবনটা দেওয়ার মাঠটা কোথায়? কর্মসূচি কোথায়?”

আড়াই মাস পর তালা ভেঙে বিএনপি কার্যালয় খোলা হলেও নেতা-কর্মীদের তেমন আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। গত ১১ জানুয়ারি তোলা ছবি – সকাল সন্ধ্যা

কথা বললেই বহিষ্কারের খড়গ নেমে আসে দাবি করে তিনি বলেন, “বিএনপি এখন আছে ব্যানার পোস্টার আর ফেইসবুক নিয়ে। ফেইসবুকের আন্দোলন বন্ধ না হলে ফসল ঘরে তোলা যাবে না।”

নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত নানা সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ‘সরকার ভুয়া’ বলে স্লোগান দিয়ে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে।

তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বিএনপি নেতা আজগর আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আব্দুস সালাম এখন নিজেই ভুয়া হয়ে গেছেন।”

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক সম্রাট মিয়াজির অভিযোগ, বিএনপির অনেক নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন। আর নামকাওয়াস্তে কর্মসূচি পালন করেন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেতারা বলেন, মিছিল করে তাদের কাছে ছবি পাঠাতে। এটা বলেই তারা খালাস। ছাত্রদলের সভাপতি–সাধারণ সম্পাদক কেউ ২৮ অক্টোবরের পর মাঠে নামেনি।”

২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির টানা হরতাল-অবরোধে দলটির নেতাদের রাজপথে তেমন দেখা যায়নি। ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় সাত-আটজন নেতাকে টায়ার পুড়িয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে দেখা গেছে।

“২৮ অক্টোবর পল্টনে যে জন জোয়ার ছিল। সেদিনের পরে বড় বড় লাইন দেওয়া বড় মাপের নেতারা সব গর্তে ঢুকে গেলেন। এভাবে কোনো আন্দোলন হয় না,” ক্ষোভ ঝাড়লেন পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকা গাজীপুরের এক বিএনপি নেতা। 

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাকে না পেয়ে আমার ছোট ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমার বউ ছেলে-মেয়ে আতঙ্কে আছে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাদের হুমকি-ধমকিও বেড়ে গেছে।” 

“লিফলেট বিতরণ করে সরকারের পতন ঘটাবেন সিনিয়র নেতারা!” কর্মসূচি দেখে ক্ষুব্ধ কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার বিএনপি নেতা জব্বার মিয়া। 

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পুলিশের ভয়ে এলাকায় যেতে পারি না। কাজও বন্ধ। ঘরে বউ, ছেলে, মেয়ে আর মা আছে বয়স্ক। ভোটের পরে ভাবলাম, একটা শেষ লড়াই হবে। বউকে বলছিলাম কয়টা দিন অপেক্ষা করো। বউ এখন বিরক্ত। খোঁটা দিয়ে বলে, আর কতদিন?”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মনে করেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভুলের কারণেই বিএনপির এই হাল।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২৮ অক্টোবরের পর কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে দুই বার পুলিশের হাতে আটক হয়েছি। একবার ৫০ হাজার আরেকবার ৭ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছি।”

“এভাবে দলের ভবিষ্যৎ কী জানি না, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ একদম শেষ,” বলেন জব্বার। 

সামনে কী কর্মসূচি

ভোটের লিফলেট বিলির মতো গণসংযোগ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি শীর্ষ নেতারা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকও শুরু করেছে। এসব আলোচনায় গত কয়েক মাসে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। আর সিদ্ধান্ত হয়েছে, গণসংযোগ চলবে।

কর্মীদের প্রত্যাশিত কর্মসূচি কেন নেই- জানতে চাইলে বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব সাম্প্রতিক নির্বাচনের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে মাঠের আন্দোলনের জোরাল কর্মসূচি দেওয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত নিরীহ কর্মসূচিতে থাকার কথাই ভাবা হচ্ছে।”

বিএনপির এই অবস্থানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে এদেশের রাজনীতি এখন বিদেশিদের হাতে।”

বিএনপিকে সামনে এগিয়ে যেতে যোগ্য নেতৃত্ব নিশ্চিতে জোর দেন তিনি। একই কথা বলেন নাগরিক সংগঠন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা দেখছি, বিএনপি এখন নেতৃত্বশূন্য। তাই কোনো কিছু গুছিয়ে উঠতে পারছে না। নিঃসন্দেহে তাদের জনশক্তি অনেক। সেটাকে কাজে লাগাতে দক্ষ নেতার মাধ্যমে কর্মসূচি বাড়াতে হবে।”

তৃণমূলের ক্ষোভ-হতাশা নিয়ে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলাম। জনগণ ভোট দিতে যায়নি। বিএনপি আন্দোলনে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত অবৈধ সরকারের পতন না হচ্ছে, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার না হচ্ছে, আন্দোলন চলবে।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান জানান, কর্মসূচি নিয়ে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন তারা।

বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভোট বর্জন করে জনগণ তাদের বার্তা দিয়ে দিয়েছে। এখন দেশের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মরিয়া হয়ে লড়াই করতে হবে। হাল ছেড়ে দিলে সবার ভবিষ্যৎ শেষ।”

তবে বিএনপির কাজে হতাশা প্রকাশ করে তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা আরেক নেতা বলেন, “যে গতিতে চলছে, সেভাবে চললে আরও দুটি নির্বাচনও চলে যাবে, আর এই আওয়ামী লীগের সরকার হবে। বিএনপির মধ্যে বুঝদার লোকের অভাব রয়েছে।”

নমনীয় কর্মসূচি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পুলিশের হয়রানিতে দলের নেতা-কর্মীরা ঘরেই থাকতে পারছেন না, মাঠে নামবেন কী করে?

“তবে এভাবে জেলে ঢুকিয়ে, তালা মেরে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মুল করা যাবে না। আর তারই প্রমাণ এই কার্যালয়ে প্রবেশ। যতবার তালা দিবেন ততোবার ভাঙব।”

তালা ভেঙে কার্যালয়ে ঢোকাকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাচন পরবর্তী পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে কার্যালয়ে প্রবেশ করা। এবার সামনের দিনগুলো নিয়ে পরিকল্পনা সাজাব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত