বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের উত্থান সূচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। দিনটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসাবে পালন করে তার গড়া দল বিএনপি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার দিনটি ঘটা করে আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের পর হাঁফ ছাড়া বিএনপি ৭ নভেম্বর পালনে ১০ দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর বিএনপির এই দিবস পালন জিয়ার কবরে ফুল দেওয়া আর আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এবার কর্মসূচির পরিসর বাড়ানো নিয়ে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনকালে দীর্ঘ দিন তারা কর্মসূচিই পালন করতে পারেননি। এবার তাই বড় আকারে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারা এরইমধ্যে ৭ নভেম্বরকে উদযাপনে প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছে। নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে চলছে একের পর এক সভা।
আয়োজন সংশ্লিষ্টরা জানায়, এবার সারাদেশে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড সামনে এনে দিনটি উদযাপন করবে বিএনপি।
বিপ্লব ও সংহতি দিবস কী?
মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার জিয়া স্বাধীনতার পর ছিলেন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান, যদিও জ্যেষ্ঠতার নিরিখে তারই সেনাপ্রধান হওয়ার কথা ছিল বলে তার সমর্থক সহকর্মীরা মনে করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে শাসন ক্ষমতা নিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন খোন্দকার মুশতাক আহমেদ।
রাজনৈতিক টালমাটাল সেই পরিস্থিতিতে ৩ নভেম্বর আরেক অভ্যুত্থানে মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। তিনি জিয়াকে গৃহবন্দি করে নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন।
এরপর ৭ নভেম্বর জাসদ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের নেতৃত্বে হয় আরেকটি অভ্যুত্থান, তাতে খালেদ মোশাররফসহ তার সঙ্গীরা নিহত হন, বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন জিয়া।
মুক্ত জিয়াই শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। পরে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন। আবাার সামরিক আদালতে কথিত বিচারের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝোলান তাহেরকে।
জিয়া পরে রাষ্ট্রপতি হয়ে বিএনপি গঠন করেন। ১৯৮১ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে পালিত হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বিএনপি দিনটি বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসাবে পালন করে। জাসদ দিনটি পালন করে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসাবে। আওয়ামী লীগ পালন করে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যা দিবস হিসাবে।
জিয়ার শাসনামলে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হত। দিনটিতে সাধারণ ছুটিও থাকত। বিএনপিকে হটিয়ে সেনাপ্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার পরও দিনটি একই মর্যাদায় ছিল। এরপর ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর দিনটি ঘটা করেই পালিত হতো।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর দিনটি জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ পড়লেও ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফেরার পর আবার আগের জায়গায় ফেরে দিবসটি।
২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর জরুরি অবস্থা পেরিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে দিনটি আবার আগের মর্যাদা হারায়।
এবার কেন ভিন্ন?
বিএনপি নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১০ সাল পর্যন্ত একদিনের জন্য ছোট করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা করতে পারলেও তারপর থেকে সেভাবে কোনও কর্মসূচি তাদের পালন করতে দেয়নি আওয়ামী লগ সরকার।
শায়রুল কবির খান বলেন, ২০১০ সালে ৭ নভেম্বর নয়াপল্টন বিএনপি অফিস সামনে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সমাবেশে বক্তব্য রেখেছিলেন। পরে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আর ৭ নভেম্বর কোনও কর্মসূচিই পালন করতে দেওয়া হয়নি।
“৭ নভেম্বর উপলক্ষে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছিল বিএনপি। সেই সমাবেশেই সর্বশেষ খালেদা জিয়া বক্তব্য দিয়েছিলেন।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৭ নভেম্বর পালনের মধ্য দিয়ে বিএনপি নতুন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা উদযাপন করবে বলে জানান দলটির এক নেতা।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত সরকারের শাসনামলে আমাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক চর্চা যেটা, সেটাও করতে দেওয়া হয়নি। অনেকেই নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় দিতেও ভয় পেত। নানাভাবে নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হতে চেয়েছে।
“ফ্যাসিবাদের পতনের মধ্যদিয়ে বিএনপি এবং পুরো দেশ নতুন করে শ্বাস নিতে পারছে। আমার মনে হয়, এবারের বিপ্লব ও সংহতি দিবসের মূল পার্থক্য আসলে স্বাধীনতা উপভোগের।”
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহবায়ক আমিনুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই দিনটি যে একটি জাতীয় বিপ্লবের দিন, ঐতিহাসিক দিন, তা আওয়ামী লীগ ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছেই ফেলেছিল। এখন জনগণকে নিয়ে দিনটি পালনের উদ্দেশ্য নতুন করে আশা দেওয়া, গণতন্ত্রের স্বাদ নেওয়া।”
দিনটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার আন্দোলন ব্যর্থ হলে জিয়াউর রহমানের ফাঁসি হতো। বন্দি অবস্থায় তাকে সারা দেশের সিপাহী-জনতা মুক্ত করেছিল। তার হাতে দেশ পরিচলানার দায়িত্ব দিয়েছিল। এর এক বিশাল তাৎপর্য আছে।”
৮ নভেম্বর ‘সর্ববৃহৎ’ শোভাযাত্রার আয়োজন
দিবসটি উপলক্ষে বিএনপির কর্মসূচিগুলো হচ্ছে- ৬ নভেম্বর বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে আলোচনা সভা, ৭ নভেম্বর সারাদেশে দলীয় কার্যালয়গুলোয় দলীয় পতাকা উত্তোলন, ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন, ৮ নভেম্বর ঢাকায় শোভাযাত্রা, জাসাসের উদ্যোগে শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এবার দিবসটি পালনে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে আহ্বায়ক, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সদস্য করে ৩ সদস্যের র্যালি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সেই শোভাযাত্রা আয়োজন নিয়ে গত সোমবার দলের ঢাকা মহানগর এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে যৌথসভা করেন জাহিদ হোসেন।
৮ নভেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক প্রদিক্ষণ করবে। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও নেতাকর্মীরাও কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে যোগ দেবে।
শোভাযাত্রায় পোস্টার ও ব্যানারে বিএনপির শীর্ষ তিন নেতার বাইরে কারও ছবি ব্যবহার না করা, সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জাসাসের আয়োজনে ব্যান্ড পার্টির বাইরে কোনও ঢোল, হাতি ও ঘোড়ার ব্যবহার না করতেও বলা হয়েছে।
জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিগত সরকার জনগণের মন থেকে জিয়াকে মুছে দিতে চেয়েছিল, কিন্ত তারা ব্যর্থ হয়। ৮ নভেম্বর হবে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ র্যালি, যা ইতিহাস গড়বে। ৮ নভেম্বরের র্যালিকে আমরা জনস্রোতে পরিণত করব।”
এছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ, বিভাগীয় শহরগুলোতেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা করছে বিএনপি।
গত রবিবার পোস্টার বিতরণ ও প্রস্তুতি সভা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। এই শাখার সভাপতি মো. আবু হোরায়রা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল জাতীয় এ দিবসটির মাহাত্ম্যকে সামনে রেখে কার্যক্রম চালাচ্ছি। সুশৃঙ্খলভাবে সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”