‘অনেকটা আবেগ আপ্লুত’ অবস্থায় বুধবার সংবর্ধনার সময় এস আলম গ্রুপের গাড়িতে চড়েছিলেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। সোমবার ঢাকায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ‘অনিচ্ছকৃত সেই ভুলের জন্য’ দেশবাসীর মনে কষ্ট লাগলে সেজন্য দুঃখও প্রকাশ করেছেন তিনি।
আলোচিত-সমালোচিত এস আলম গ্রুপের গাড়িতে চড়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সমস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নিজ এলাকায় সংবর্ধনা নেওয়ার ঘটনা নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশে ফেরেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের দুই বারের সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন। দেশে ফিরে গত বুধবার প্রথম গ্রামের বাড়ি যান তিনি। কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদের গাড়িবহর পেকুয়ায় পৌঁছানোর বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
ভিডিওতে দেখা যায়, যে গাড়িতে (জিপ) চড়ে সালাহউদ্দিন কক্সবাজার থেকে পেকুয়ায় যান, সেটির নম্বর চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩। এটি মিতসুবিশির স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের জিপ। সালাহউদ্দিন গাড়ির সামনে সিটে বসে হাত নেড়ে আশপাশের লোকজনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিববহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সালাহউদ্দিন আহমেদকে বহন করা গাড়িটি (চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩) এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন।
এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে এটি ২০১০ সালে নিবন্ধন করা। ঠিকানা লেখা আছে– এস আলম ভবন, চট্টগ্রাম নগরের আছাদগঞ্জ। সেটি এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়। বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালক আইনুল হুদা গাড়িটি এস আলম গ্রুপের নামে নিবন্ধন করা বলে নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগের শাসনকালে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক দখল করে লক্ষ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তার তদন্তও শুরু হয়েছে।
সোমবার দুপুরে ঢাকার গুলশানে নিজ বাসায় ‘জরুরি ওই সংবাদ সম্মেলনে’ পুরো ঘটনা তুলে ধরে দুঃখ প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “গাড়ি সংক্রান্ত যে সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে তাতে জনমনে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তারপরও একটি পুরাতন গাড়ি, সে আমার ছোট ভাই নিয়ে গেছে। সে খুব আনন্দিত যে আমি তার গাড়িতে চড়তে উঠেছি। এটা আমার পক্ষ থেকে যদি জানতাম, যে একটা কোম্পানির গাড়ি, তাহলে হয়তো আমি সাবধানতা অবলম্বন করতাম।
“তারপরও আমার এই অসাবধানতা ও এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য যদি আমি দেশবাসীর মনে কষ্ট দিয়ে থাকি এবং অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকি সেজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
সালাহউদ্দিন বলেন, “গতকালকে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, আমি দীর্ঘ ১০ বছর পর আমার নিজ জেলা কক্সবাজারে অবতরণ করলে সেখানে আমার দলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “সেখানে একটি গাড়ি আমি ব্যবহার করেছি। যে গাড়ি একটি কোম্পানির। যা সংবাদ লেখা হয়েছে এস আলম কোম্পানির। আমি কোন গাড়িতে উঠেছি, সেটা আমি নিজেও জানতাম না। সেদিন কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামার পর কিছু গাড়ি দেখেছি ভেতরে। আমাদের নেতা-কর্মীরা বলল যে, এটাতে উঠেন… এই গাড়িতে। আমি উঠেছি।
“সেই গাড়িটি কার, সেই মুহূর্তে আমি সে চিন্তা-ভাবনার মধ্যে ছিলাম না। আমি তখন অনেকটা আবেগ আপ্লুত ছিলাম। দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছিলাম এবং মা-বাবার কবর জিয়ারতের বাসনায় মগ্ন ছিলাম। তখন আমার মনের অবস্থা এমন ছিল না যে, আমি কোন গাড়িতে, কার গাড়িতে উঠছি।”
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সংবাদটি (গণমাধ্যম) প্রকাশ হওয়ার পরে আমি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি জানতে পারলাম এই গাড়িটি আমার এলাকার এক ছোট ভাইয়ের। যে, উক্ত কোম্পানিতে বিভিন্ন জমি-জমা দেখাশুনার কাজ করে এবং কোম্পানি থেকে তাকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহারের জন্য এই গাড়িটি দেওয়া হয়।
“সেও অন্য সকলের মতো আমাকে বরণ করার জন্য এয়ারপোর্টে গেছে। তার গাড়িতে করেই গেছে। সেও জানত না যে আমি তার গাড়িতে উঠব। আমিও জানতাম না যে, আমি কার গাড়িতে উঠব। এটা জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ ঠিক করেছে।”
এস আলমের গাড়ির এই ঘটনায় কোনও ষড়যন্ত্র দেখছেন কিনা- জানতে চাইলে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিষয়টা আমি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই। আমাদের সবার উচিত পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য সম্বলিত সংবাদ প্রকাশ করা।
“যারা দীর্ঘ ১৫ বছরে দেশটাকে বিভিন্নভাবে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দেশের বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগসহ এমনকি ফোর্থ স্টেট মিডিয়াসহ সর্বত্র যে বিভিন্ন পর্যায়ে পচন ধরেছে, ফ্যাসিবাদের যে স্বাক্ষর তারা এখানে রেখেছে তাদের ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘায়িত করার জন্য সেই বিষয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। আমাদের এখন অগ্রাধিকার সেটা।”
তিনি বলেন, “আমরা যেন যারা গুম, খুন, অপহরণের সাথে জড়িত ছিল, আয়নাঘরের সাথে জড়িত ছিল, যারা ফ্যাসিবাদের শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন স্তর থেকে সহযোগিতা করেছে তাদের মুখোশ উন্মাচন করি।”
তাদের কেউ কেউ হয়ত গ্রেপ্তার হয়েছে একথা উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “কিন্তু আমি যতটুকু জেনেছি তাদেরকে যথাযথভাবে ইন্টারোগেশন করা হচ্ছে না। আজ পর্যন্ত কোনও গুমের রহস্য উন্মোচন করা যাচ্ছে না। দেশবাসীর আকাঙ্ক্ষা ছিল আমরা যেন গুম-খুনের আস্তানা খুঁজে বের করি, গুম-খুনের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করি। তাদের মুখোশ উন্মোচন করি।”
সংবাদ সম্মেলনে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারে’ সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বর্তমান যে অন্তর্বতীকালীন সরকার আছে আমরা তাদেরকে সহযোগিতা করি। তারা যেন জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার করতে পারে- সেজন্য তাদের সহযোগিতা করি।”
এসময় আবারও এস আলম গ্রুপের গাড়ির চড়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত পর্যায়ে যা কিছু এগুলো পরিহার করলে আমরা মনে হয় ভালো হয়। তারপরও আমার অসাবধনতার জন্য আমি আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি।”
একটি গণমাধ্যমে গাড়িচালক তার পরিচিত বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এই কথা আমি ওই পত্রিকার রিপোর্টারকে বলিনি। এটা কীভাবে লিখেছেন আমি জানি না। এটা মিস কোট করা হয়েছে।
“ওই খানে একটা মাইক্রোবাস ছিল; যার ড্রাইভারটা আমার এলাকার ছিল। আমি মনে হয় ওই গাড়িতে উঠতে ছেয়েছিলাম যে আমার পরিচিত। মাইক্রোবাসে উপরে হুট খোলা নেই বলে আমাকে সেই গাড়িতে উঠতে তারা দেয়নি। হয়ত বা এগুলো বলতে গিয়ে পত্রিকার রিপোর্টার আমার বক্তব্য মিস কোট করেছেন।”
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সালাহউদ্দিন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ জুন কক্সবাজারে গিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন।
২০১৫ সালের ১১ মে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। এরপর থেকে ভারতেই ছিলেন সালাহউদ্দিন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশে ফেরেন তিনি।