রাতের আঁধারে এস আলম গ্রুপের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরাতে সহায়তা করে চট্টগ্রামে দলের সদস্যপদ হারিয়েছেন বিএনপির তিন নেতা। সেই ঘটনার রেশ না কাটতেই এস আলম গ্রুপের গাড়িতে চড়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সংবর্ধনা নেওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে।
আলোচিত-সমালোচিত এস আলম গ্রুপের গাড়ি সরাতে সহায়তা করে তিন নেতার পদ খোয়ানোর প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধেও কি ব্যবস্থা নেবে বিএনপি?
এস আলমের গাড়ি সরানোর কাজে সহায়তা করায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও কর্ণফুলী থানা শাখার আহ্বায়ক এসএম মামুন মিয়াকে প্রথমে শোকজ করে দলটি। পরে রবিবার রাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিএনপি তাদের সদস্যপদ স্থগিত করার কথা জানায়। একইসঙ্গে তাদের নেতৃত্বে যে কমিটি ছিল, সেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে বিএনপি সারাদেশের নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা দিয়েছে, যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনারাবৃত্তি না ঘটে।
তবে এই ঘটনার রেশ না কাটতেই সামনে আসে এস আলম গ্রুপের গাড়িতে চড়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নিজ এলাকায় গিয়ে সংবর্ধনা নেওয়া ঘটনা। এ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
নয় বছর পর দেশে ফিরে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রথম নিজগ্রামের বাড়িতে যান বুধবার। ওইদিন বেলা পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা থেকে তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর দলের নেতাকর্মীদের গাড়িবহরের সঙ্গে প্রথমে চকরিয়া, পরে পেকুয়ায় পৌঁছান তিনি।
কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদের গাড়িবহর পেকুয়ায় পৌঁছানোর বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
ভিডিওতে দেখা যায়, যে গাড়িতে (জিপ) চড়ে সালাহউদ্দিন কক্সবাজার থেকে পেকুয়ায় যান, সেটির নম্বর চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩। এটি মিতসুবিশির স্টেশন ওয়াগন ব্র্যান্ডের জিপ। সালাহউদ্দিন গাড়ির সামনে সিটে বসে হাত নেড়ে আশপাশের লোকজনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিববহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সালাহউদ্দিন আহমেদকে বহন করা গাড়িটি (চট্ট মেট্রো ঘ-১১-১৫৩৩) এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন।
এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে এটি ২০১০ সালে নিবন্ধন করা। ঠিকানা লেখা আছে– এস আলম ভবন, চট্টগ্রাম নগরের আছাদগঞ্জ। সেটি এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়।
বিআরটিএ চট্টগ্রামের উপপরিচালক আইনুল হুদা গাড়িটি এস আলম গ্রুপের নামে নিবন্ধন করা বলে নিশ্চিত করেছেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদের এস আলম গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের ঘটনাটি ঘটে বুধবার। আর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতাদের নেতৃত্বে এস আলমের বিলাসবহুল ১৪ গাড়ি সরানো হয় বৃহস্পতিবার রাতে। অর্থাৎ সালাহউদ্দিনের ঘটনাটি ঘটে একদিন আগে।
কিন্তু সালাহউদ্দিনের বিষয়টি জানাজানি হয় রবিবার। আর দক্ষিণ জেলা বিএনপি নেতাদের ঘটনাটি জানাজানি হয় শুক্রবার রাতে।
এস আলমের গাড়ি সরাতে সহায়তা করায় তিন নেতার সদস্যপদ স্থগিত করা বিএনপি সালাহউদ্দিন আহমেদের বেলায় কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে ফোন করে সাড়া মেলেনি।
এস আলম গ্রুপের গাড়িতে চড়ে এসে নিজ এলাকায় সংবর্ধনা নেওয়ার বিষয়ে রবিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, “শত শত লোক এসেছে। কার গাড়িতে উঠেছি জানি না। যে চালক গাড়িটি চালিয়েছেন, তিনি সাত-আট বছর ধরে আমার পরিবারের গাড়ি চালিয়ে আসছেন।”
কেন এস আলমের গাড়িতে চড়েছিলেন সালাহউদ্দিন
সালাহউদ্দিন আহমেদের এস আলমের গাড়িতে চড়ার যেসব ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে, তার একটিতে সালাহউদ্দিনের সঙ্গে তার প্রেস সচিব ও ভাতিজা ছফুয়ানুল করিমকে দেখা গেছে।
তিনি সোমবার দুপুরে সকাল সন্ধ্যাকে জানান, গাড়িটি পেকুয়ার ব্যবসায়ী লায়ন মুজিবুর রহমান ব্যবহার করেন। বিমানবন্দরে সালাহউদ্দিন আহমেদের পৌঁছানোকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের জমায়েত হয়। ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসা সালাহউদ্দিনের নিজস্ব গাড়িটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি।
এর মধ্যে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বের হলে অনেকগ গাড়িতে তাকে উঠতে বলা হয়। কিন্তু লায়ন মুজিবের গাড়িটি ছাদ খোলার সুবিধা থাকায় ওই গাড়ি উঠেন সালাহউদ্দিন। লায়ন মুজিবুর পেকুয়ার সন্তান ও বিএনপি সমর্থক।
ছফুয়ানুল বলেন, “পরে খোঁজ নিয়ে গাড়িটি এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে। লায়ন মুজিব এস আলমের মাতারবাড়ি প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন। প্রতিষ্ঠান লায়ন মুজিবকে এই গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছে।
“ওই গাড়িতে পেকুয়া আসলেও সালাহউদ্দিন পরের দিন নিজের গাড়িতে বিমানবন্দরে গেছেন। আমরা কক্সবাজার, চকরিয়া, পেকুয়া থেকে প্রতিদিনই তো এস আলমের গাড়িতে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাচ্ছি। ওখানে কোনও সমস্যা নেই। তাহলে লায়ন মুজিবের অনুরোধে গাড়ি তো ওঠা অপরাধ হলো কীভাবে?”
এ ব্যাপারে লায়ন মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গাড়িটি এস আলমের মালিকানাধীন বলে স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, “মাতারবাড়ি প্রকল্পসহ কক্সবাজারে এস আলমের অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজে গাড়িটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ওই দিন বিমানবন্দরে তিনিসহ কয়েকজন গাড়িটি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দরে পৌঁছার পর ওখানে নিজস্ব গাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি।
“ফলে কোন গাড়িতে সালাহউদ্দিন আহমেদ উঠবেন- এটা নিয়ে এক-এক জন ভিন্ন ভিন্ন গাড়ির কথা বলেছিল। পরে সুবিধার কারণেই এই গাড়িটিতে ওঠেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ।”
সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ জুন কক্সবাজারে গিয়েছিলেন সালাহউদ্দিন। সেদিন তিনি জেলা জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরের বছর ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকার উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন।
ওই বছরের ১১ মে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। এরপর থেকে ভারতেই ছিলেন সালাহউদ্দিন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশে ফেরেন তিনি।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সালাহউদ্দিন।