ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়াতে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন তপন কুমার সরকার।
চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফল নিয়ে আপত্তি তুলে রবিবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাওয়ে গিয়েছিল একদল শিক্ষার্থী। সেখানে তাদের সঙ্গে মারামারি বাধে বোর্ড কর্মচারীদের, তাতে কয়েকজন আহতও হয়।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মুখে রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন তপন কুমার। সোমবার সকালেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব জোবায়ের সিদ্দিকের কাছে আবেদনপত্র জমা দেন তিনি।
সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এবছর যে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে তা বৈষম্যমূলক বলে অভিযোগ করছে কিছু শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, সবগুলো বিষয়ের ওপর ‘ম্যাপিং’ করে আগের ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ফলাফল প্রকাশ করা হোক।
আর এই দাবি নিয়েই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ গিয়েছিল ঢাকা বোর্ডে, সঙ্গে ছিলেন কিছু অভিভাবকও।
তাদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, বোর্ডের কর্মীদের সঙ্গে মারপিটে জড়ানোর খবরের পরই পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সকালেই সচিব মহোদয়ের কাছে আমি প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়ে এসেছি। সরকারি চাকরীজীবীদের তো পদত্যাগের সুযোগ নেই, তাই বোর্ড চেয়ারম্যানের পদ থেকে আমাকে প্রত্যাহার করে অন্য কোথাও দায়িত্ব দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি।
“শিক্ষার্থীরা ভাবছে যে আমার জন্য তাদের ফল খারাপ হয়েছে, তারা ফেল করেছে, বৈষম্য হয়েছে; সেজন্য আমি স্বেচ্ছায় এই পদ থেকে সরে যেতে চাচ্ছি।”
তিনি দায়িত্ব থেকে সরে গেলেই শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী অটো পাস দিয়ে দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তপন কুমার বলেন, “গতকাল যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আমাকে অবরুদ্ধ করেছে, তখনই আমি এই ঘোষণা দিয়েছি। আমার পদত্যাগে যদি তাদের অটো পাসের দাবি পুরণ হয় তাহলে যেন আমাকেসহ অবরুদ্ধ সবাইকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।
“এখন সেই দাবি কীভাবে পূরণ হবে, আদৌ পূরণ হবে কিনা সেটা এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন কী করবে তা জানতে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব জোবায়ের সিদ্দিককে একাধিকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
তবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন জানিয়েছেন, বোর্ড চেয়ারম্যানের আবেদনপত্র সচিব গ্রহণ করলেও এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। দুয়েকদিন সময় নিয়ে তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
তপন কুমার সরে গেলেই যে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়া হবে, এমন কোনও ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই-বাছাই করেই সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার সুযোগ নেই।
এর আগে রবিবার তপন কুমার সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, কেউ যদি মনে করে, ফলাফল সঠিক নয়, তারা বঞ্চিত হয়েছে, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী তারা ফল পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারে। বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে বিক্ষোভ করলে সমাধান হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা ছাড়াও রবিবার চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লাসহ দেশের পাঁচটি শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও, অবস্থান কর্মসূচি ও বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষা হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, দায়িত্বে আসে অন্তর্বর্তী সরকার।
ব্যবহারিকসহ স্থগিত ছয় বিষয়ের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে গত ২০ আগস্ট সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করে কিছু পরীক্ষার্থী। সেসময় স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা দেয় শিক্ষা বিভাগ।
১৫ অক্টোবর এইচএসসি-সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। কিছু পরীক্ষা বাতিলের কারণে এবার এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন হয় ভিন্ন পদ্ধতিতে। যাকে বলা হচ্ছে সাবজেক্ট ম্যাপিং।
এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় যত নম্বর পেয়েছিল, সেটা এইচএসসিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর এইচএসসিতে যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা হয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্রের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হয়েছে। এ দুই মূল্যায়ন মিলে এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করা হয়।
তবে এই পদ্ধতিকে বৈষম্যমূলক দাবি করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছে, বাতিল ছয়টি পরীক্ষা যে পদ্ধতিতে ম্যাপিং করে ফলাফল তৈরি করা হয়েছে তা চরম বৈষম্যমূলক। ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য ঢালাওভাবে ভুল ফলাফল দেওয়ার অভিযোগও করা হয়েছে।
শিক্ষাবোর্ড ঘেরাওকে অংশ নেওয়া মতিয়াজ খান ইন্তু নামে এক শিক্ষার্থী সকাল সন্ধ্যাকে বলে, “কোনও বোর্ডে কেউ ৬টি পরীক্ষা দিয়েছে, কেউ ৩টি পরীক্ষা দিয়েছে। অথচ রেজাল্টের ক্ষেত্রে কম পরীক্ষা দেওয়া বোর্ডের রেজাল্ট ভালো হয়েছে। এই ফলাফল আমরা মানি না। অবিলম্বে ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে নতুন পদ্ধতিতে রেজাল্ট প্রকাশের দাবি জানাতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।”
আবারও জড়ো হওয়ার চেষ্টা, নিরাপত্তা জোরদার
রবিবারের ধারাবাহিকতায় সোমবারও ফলাফল বাতিল করে এইচএসসিতে সবাইকে পাস করানোর দাবিতে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে জড়ো হয়েছিল কিছু শিক্ষার্থী। যদিও দুপুরের পর আর টিএসসিতে কাউকে দেখা যায়নি।
তবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম বোর্ডসহ দেশের সব শিক্ষা বোর্ডে সেনাবাহিনীর সদস্য ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
হামলার প্রতিবাদে বোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানববন্ধন
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষার্থীদের হামলা, ভাঙচুর এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধরের প্রতিবাদে সোমবার ঢাকা বোর্ডের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
দেশের সব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যানারে এ কর্মসূচিতে তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে অংশ নেন।
মানববন্ধন থেকে শিক্ষা বোর্ডের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর, অরাজকতা সৃষ্টি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরে হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়।