যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনচর্যা নিয়ে বানানো অ্যাানিমেশন টেলিভিশন সিরিজ ‘দ্য সিম্পসনস’-এর সি মন্টগোমারি বার্নসকে অনেকে চিনে থাকতে পারেন। সিরিজের সম্পদশালী এই চরিত্র অনেক দুষ্টু, অসৎ এবং লোভী। একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক তিনি। ‘দ্য সিম্পসনস’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র হোমার জে সিম্পসনের বস এই মিস্টার বার্নস ।
তো এই সুপারভিলেনকে নিয়ে সম্প্রতি একটি মিম বানিয়েছে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার কয়েকজন তরুণ। এতে দেখা যায়, হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ আর হৃদয় আকৃতির চকলেট বাক্স হাতে কারোর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে মিস্টার বার্নস। মুখে হাসি নিয়ে গৃহকর্তাকে বলছে, “আমি জেনেছি, তোমার ঘরে পানি সরবরাহের সময়সূচি আমার থেকে আলাদা।”
মিমটি সোশাল মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। কারণ এটির ডার্ক হিউমার বা ব্যাঙ্গাত্মক বার্তা। বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ নিয়ে মিমের মাধ্যমে এ ধরনের ডার্ক হিউমার উপস্থাপনের তাগিদ লাতিন আমেরিকার শহরটির তরুণরা বোধ করল কেন?
বোগোতা বর্তমানে এমন এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা শহরবাসী আগে দেখেনি। এল নিনোর প্রভাবে সৃষ্ট খরায় বোগোতার জলাধারগুলোতে পানি রেকর্ড পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এ কারণে শহরটির কর্তৃপক্ষ পানি রেশনিং অর্থাৎ সরবরাহের ওপর কড়াকড়ি করা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছে না।
সংকট মোকাবেলায় কলম্বিয়ার রাজধানীর নীতি-নির্ধারকরা সোমবার পানি রেশনিংয়ের ঘোষণা দেন এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় ওই মিম বানানো হয়।
কেবল বোগোতা নয়, এর আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পানি রেশনিংয়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে গেছে। এসব শহরে আনুমানিক ৯০ লাখ মানুষের বাস।
পানি রেশনিংয়ের আওতায় পড়া শহরগুলোকে নয়টি জোনে ভাগ করেছে বোগোতা কর্তৃপক্ষ। এক এক জোনের বাসিন্দারা প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পানি পাচ্ছেন। এই সময় আবার ১০ দিন পরপর বদলানো হবে।
অবশ্য স্কুল ও হাসপাতালকে রেশনিংয়ের আওতার বাইরে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সেখানে পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বরাবরের মতোই থাকবে।
পানি রেশনিংয়ের ঘোষণার পর বোগোতার তরুণদের একাংশ ভাবতে শুরু করেন, শহরের বাইরের বন্ধুদের কাছে খাবার পানির জন্য ধরনা দেবেন কি না?
বোগোতা ও তার আশপাশের শহরে পানি সরবরাহের সময় ভিন্ন হওয়ায় রাজধানীর তরুণরা যেসময় পানি পাবেন না, সেসময় পাশের শহরে বাস করা তাদের বন্ধুদের ঘরে পানি থাকবে। তাদের ঘরে ধরনা দেওয়ার চিন্তা থেকেই সেই মিমের উৎপত্তি।
জলাধারে পানি হ্রাস
কলম্বিয়ার জলাধারগুলোতে পানির পরিমাণ অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় জরুরি পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেশটির সরকার ও বোগোতার মেয়র পানি রেশনিংয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
বোগোতার বাসিন্দাদের খাবার পানির ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় দেশটির চুজা ও সান রাফায়েল জলাধার থেকে। এ দুটি জলাধারে পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
বোগোতার মেয়র কার্লোস ফেরনান্দো গেলান সোমবার পানি রেশনিংয়ের ঘোষণার সময় শহরবাসীর উদ্দেশে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আসুন, এক ফোঁটা পানিও যেন আমরা অপচয় না করি। অপচয় বন্ধ করলে পানি সরবরাহের ওপর কড়াকড়ি দ্রুতই উঠে যাবে বা কমবে।”
বছরের এ সময়ে কয়েকটি জলাধার ঐতিহাসিক গড়ের তুলনায় ২০ শতাংশের কম ধারণ ক্ষমতায় রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান মেয়র।
লাতিন আমেরিকার শহরে পানি সংকট নতুন কোনও ঘটনা নয়। বোগোতার উত্তর পশ্চিমে মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটির অবস্থান। সেখানকার মানুষও পানি সংকটের কবলে পড়তে যাচ্ছে।
তবে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরের মানুষ পানির ঘাটতির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই প্রথম পানি রেশনিংয়ের মতো পদক্ষেপ বোগোতাকে নিতে হয়েছে।
বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীলতা
পর্বত মালভূমিতে অবস্থিত বোগোতা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রাজধানীর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে আট হাজার ফুট উঁচুতে এর অবস্থান।
বোগোতার পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালা। পশ্চিমে সবুজ উপত্যকা, যেখানে বয়ে চলেছে ম্যাগদালেনা, কলম্বিয়ার বৃহত্তম নদী। এই নদী পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ম্যাগদালেনার ধারে ঘন বন থেকে জলীয় বাষ্প পর্বতের উপত্যকায় উঠে আসে। ওপরের তুলনামূলক শীতল তাপমাত্রার সঙ্গে এসব জলীয় বাষ্পের সংঘর্ষ বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
বোগোতার প্রতিটি মানুষের কাছে বৃষ্টি নিয়মিত ঘটনা। পানির জন্য তারা এর ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এই বিষয়ে রাজধানীর হেভেরিয়ানা ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আরমান্দো সারমিয়েন্তো বলেন, “বিশ্বের বেশির ভাগ শহর চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। বোগোতা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানকার বাসিন্দারা জলাধারের মতো ভৃ-পৃষ্ঠের পানির ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টিপাতের ধরন এসব জলাধারের ওপর প্রভাব ফেলে।”
বৃষ্টির ওপর এই নির্ভরশীলতা বোগোতাকে খরাপ্রবণ করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক সারমিয়েন্তো।
এল নিনোর প্রভাব
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, এল নিনোর প্রভাবে গত বছর থেকে বোগোতায় শুষ্ক আবহাওয়ার সময় দীর্ঘ হয়েছে।
এল নিনো হচ্ছে নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরে জলবায়ুর এমন এক অবস্থা, যা বিশ্বজুড়ে আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। কলম্বিয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের হার হ্রাসের পেছনে এল নিনোর ভূমিকা আছে।
কলম্বিয়ার জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে মতানৈক্য আছে। তবে এল নিনো মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা বিরলভাবে একমত।
উদাহরণ হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতির কথা বলা যায়। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রোর সঙ্গে রাজধানীর মেয়র কার্লোস ফেরনান্দো গেলানের সম্পর্ক মধুর না হলেও পানি সংকট মোকাবিলায় রেশনিংয়ের পদক্ষেপে তাদের দুজনেরই সম্মতি আছে।
পানি সরবরাহে চাপ
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, তাপপ্রবাহ ও খরার মতো চরম আবহাওয়াকে আরও সাধারণ ঘটনায় পরিণত করবে বৈশ্বিক উষ্ণতা। একই সঙ্গে খরা ও তাপপ্রবাহের তীব্রতাও বাড়াবে। এ অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন শহরের পানি সরবরাহের ওপর চাপ বাড়বে বৈ কমবে না।
জলাধার থেকে পানি সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি কয়েকটি শহর কর্তৃপক্ষের প্রতি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার খসড়া তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন কলম্বিয়ার পরিবেশমন্ত্রী সুজানা মুহামাদ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমরা যদি জলাধারের প্রাকৃতিক সরবরাহ চক্র এবং পানির প্রাকৃতিক চক্র নিয়ে না ভাবি, তাহলে জলাধার থেকে আগের মতো করে পানি পাওয়া যাবে না। এমনই এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা।”
হেভেরিয়ানা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সারমিয়েন্তো বলেন, “সামনের বছরগুলোতে আবহাওয়ার বিবর্তন কেমন হবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। এ কারণে শহর ও দেশ উভয়কেই ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
“এই মুহূর্তে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে পানি ব্যবহারে হিসেবি হতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরকার পড়লে গোসল করা সীমিত করতে হবে। তবে কলম্বিয়ার অন্যতম ব্যস্ত শিল্পাঞ্চল বোগোতায় পানির সংকট অন্য এলাকার চেয়ে উদ্বেগজনক। পানি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা আমাদের ব্যক্তি নয়, সমাজ হিসেবে চিন্তা করতে হবে।” বলেন তিনি।
তথ্যসূত্র: সিএনএন