Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

মাছ-মিষ্টি আর জামাইদের মিলনমেলা

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার এক মিষ্টির দোকান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার এক মিষ্টির দোকান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

মেলার শুরুটা ছিল কাঠের আসবাবপত্রের বেচাকেনা দিয়ে। কালক্রমে সেই স্থান দখল করেছে মাছ। এখন নানা ধরনের ছোট বড় মাছ নিয়ে প্রতি বছর মাঘের শেষ দিনের কাছের বুধবার মাত্র একদিনের জন্য বসে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। মেলার প্রধান ক্রেতা এ অঞ্চলের জামাইরা। সব মিলে স্থানীয়দের কাছে এই মেলা পরিণত হয়েছে উৎসবে, মিলনমেলায়।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পূর্বে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের ইছামতি নদীর তীরে প্রায় চারশ বছর ধরে বসছে পোড়াদহ মেলা। অনেকে এ মেলাকে সন্নাসী মেলাও বলেন। পোড়াদহ মেলার মূল আকর্ষণ মাছ হলেও মিষ্টি, খেলনা থেকে শুরু করে সাংসারিক প্রায় সব জিনিসপত্র বিক্রি হয়।

মেলা বুধবার হলেও এর আমেজ শুরু হয় আগের দিন সন্ধ্যাই। বুধবার সকালেই মাছের দোকানগুলোয় দর্শনার্থীদের ঢল নামতে দেখা যায়। ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পোড়াদহ মেলা জামাইদের জন্য। মেলা উপলক্ষ্যে জামাইরা শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসেন। আসার পর তাদের পোড়াদহ মেলা থেকে বড় আকারের মাছ কিনতে হয়। মাছ কেনা নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগিতায় নামতে হয় জামাইদের।

মহিষাবান ইউনিয়নের বাসিন্দা রেজাউল করিম মাইনুলের বিয়ে হয়েছে একই এলাকায়। শ্বশুরের সঙ্গে মেলায় এসে দুই হাজার টাকায় মাছ কিনেছেন।

রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের জন্মের আগে থেকে এই মেলা হয়। এখন এটা জামাই মেলা হিসেবেও পরিচিত। শ্বশুররা জামাইদের দাওয়াত করে নিয়ে আসে। জামাইরা বড় বড় মাছ কিনে নিয়ে আসে।”

মেলার জৌলুস আগের চেয়ে আরও বেড়েছে বলে মনে করেন রেজাউলের শ্বশুর মহিষাবান মণ্ডলপাড়ার মোয়াজ্জিম হোসেন মণ্ডল।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে জানান, আগে মেলা বিখ্যাত ছিল কাঠের জন্য। পরে মাছের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তারপর মিষ্টিসহ অন্যান্য জিনিসের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে মেলায় আসে লোকজন। মেলার জন্য এক মাস আগে থেকে এই এলাকার লোকজনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

একাধিকবার মেলা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন লুৎফর রহমান সরকার স্বপন। তিনি বলেন, “পোড়াদহ মেলাটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। এর মূল ঐতিহ্যের বিষয় হলো মাছ। এরপর বিখ্যাত মিষ্টি, কাঠের জন্য। আমরা মেলায় জামাইদের দাওয়াত করি।

“মেলায় তাদের টাকা গিফট করি। তারা সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যুক্ত করে বাজার করে। মেলাটি আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকে হয়ে আসছে, আমরাও এই ধারা ধরে রেখেছি।”

লুৎফর রহমান সরকার স্বপন আরও বলেন, “মেলাটি এক সময় কাঠের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন কাঠ বিলুপ্ত হয়েছে। তার জায়গায় এসেছে মাছ। আর আছে আমাদের মেহমানদারিত্ব। আপনারা জেনে অবাক হবেন এই এলাকার মানুষদের কাছে এই মেলা ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি।”

মেলা উপলক্ষ্যে বগুড়া শহরের কৈপাড়া এলাকার মনির হোসেন এসেছেন শ্বশুরবাড়ি মহিষাবান ইউনিয়নের মরিয়া গ্রামে। মেলায় জামাইদের ভূমিকা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।

সকাল সন্ধ্যাকে মনির হোসেন বলেন, “মেলায় দাওয়াত পেলে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসি। আসার পর সব শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা দিয়ে জামাইরা বাজার করেন। এখানে জামাইরাও নিজে থেকে আরও টাকা যোগ করে।

“এই মেলায় মাছের পাশাপাশি মিষ্টিও বিখ্যাত। শালা-সমন্ধীরা যারাই থাকবে তাদের মেলা থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। জামাইদের টাকা দেওয়ার এই রেওয়াজ থেকে দেখা গেছে। অনেকে প্রয়োজনে ঋণ করেও মেলার খরচ মেটায়।”

ঝর্ণা খাতুন নামে এক নারী বলেন, “ছোটবেলা থেকে দেখছি ঈদের আনন্দের চেয়ে এই এলাকার মেলার আনন্দ বেশি। আমি জামাই, বাচ্চাদের সাথে মেলায় এসেছি। প্রতিবছরই আসি।”

পোড়াদহ মেলায় একটা সময় পর্যন্ত সবার নজর থাকত বাগাড় মাছে দিকে। ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের এক বিজ্ঞপ্তিতে বাগাড় মাছকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে পোড়াদহ মেলায় বাগাড় আনছেন না ব্যবসায়ীরা।

মেলার এক মাছের দোকান। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

মাছের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ দোকানে রুই, কাতল, গ্রাসকার্প, ব্ল্যাককার্প মাছ তোলা হয়েছে। নদীর মাছের মধ্যে আইড়, বোয়াল, চিতল মাছ নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ীরা। আকার ভেদে একেক ব্যবসায়ী একেক রকম দাম হাঁকাচ্ছেন। দুই বিক্রেতা নিয়ে আসেন সামুদ্রিক তলোয়ার মাছ। দাম চাচ্ছিলেন প্রতি কেজি এক হাজার টাকা।

মহিষাবান এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মো. আপেল বলেন, “আমরা সিলভার কার্প, রুই কাতল সব ধরনের মাছ নিয়ে আসি। গতবারের চেয়ে এবার মেলা ভালো। দামও কম। তবে গতবারের চেয়ে এবার মাছ একটু কম।”

মাছের দাম সম্পর্কে আপেল আরও বলেন, “কাতল মাছ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বেচতেছি। বিগহেড মাছ ৫০০ টাকা, ব্ল্যাককার্প ৬০০ টাকা, আইড় মাছ ১২শ, ঢেউশ মাছ ১২-১৪শ, বোয়াল ১ হাজার টাকা কেজি দামে বেচতেছি।”

পোড়াদহ মেলার আরেক আকর্ষণ মিষ্টির দোকান। মেলার একেবারে দক্ষিণ অংশে বসানো হয় এই মিষ্টির দোকানগুলো।

শাজাহানপুর উপজেলার মোস্তাইলবাজার এলাকার বাসিন্দা ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মামুনুর রশিদ জানান, মাছ-মিষ্টি ৪০০ টাকা কেজি। আর সাদা মিষ্টি ২০০ টাকা, স্পঞ্জ মিষ্টি ৩০০ টাকা, হাসিখুসি ৫০০ টাকা ও বালিশ ৫০০ টাকা কেজি।

গোলাম ফারুক নামের এক ব্যবসায়ী মাছের আকৃতির নানা ধরনের মিষ্টি বিক্রি করছিলেন মেলায়। তিনি বলেন, “এবার ৭ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত সাইজের মিষ্টি আনা হয়েছে। বড় মাছ-মিষ্টি বিক্রি করছি ৪৫০ টাকা কেজি, মাঝারিটা ৩৫০ টাকা কেজি। এছাড়া সাদাকালো মিষ্টি ৩০০ টাকা, অন্যান্য মিষ্টি ৩৫০-৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি।”

ব্যবসা কেমন হলো জানতে চাইলে তিনি গোলাম ফারুক বলেন, “এবার ক্রেতা একটু কম। বেচাকেনাও কম।”

মেলা ঘুরে আরও দেখা যায়, পুরোনো এ মেলায় শুধু মাছ ও মিষ্টি নয়, ঘর সংসারের প্রায় সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে খাট, হাঁড়িপাতিল, বাঁশ ও বেতের ঝুড়ি, ঢেঁকি, কুলা, চেয়ার-টেবিল ও কাঠের দরজা উল্লেখযোগ্য। মেলায় ছিল নাগরদোলা, চরকিও।

মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর আগে এখানে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। সেখানে একদিন হঠাৎ এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। পরে সেখানে আশ্রম তৈরি করেন সন্ন্যাসীরা। একপর্যায়ে স্থানটি পূন্যস্থানে পরিণত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে।

প্রতি বছর মাঘের শেষ দিনের কাছের বুধবার মাত্র ওই স্থানে সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে হিন্দু সম্প্রদায়। ছুটে আসে দূর-দূরান্তের ভক্তরা। দিন যত যায়, স্থানটিতে লোকজনের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে। এভাবেই শুরু হয় পোড়াদহ মেলার। এ মেলা এক দিনের জন্য হয়। পরদিনই একই স্থানে বসে ‘বউ মেলা’। এ সময় সাধারণত নারীরা তাদের নানা রকম পণ্য সংগ্রহ করেন।

পোড়াদহ মেলা কমিটির সদস্য ও মহিষাবান ইউপির সদস্য সুলতান মাহমুদ বলেন, “চারশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা পোড়াদহ বা সন্ন্যাসী মেলা হয়ে আসছে। মেলাটি মূলত মাছের জন্য এবং প্রচুর মাছও বিক্রি হয় এখানে। এবার প্রায় ৫০০ মাছের দোকান আছে। ধারণা করা হচ্ছে, সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হবে এবার মেলায়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত