ঈদের রাতে বগুড়া শহরের নিশিন্দারা চকরপাড়ায় দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির মেয়ের প্রাইভেটকারের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগা নিয়ে কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে এই জোড়া খুন হয়েছে।
গভীর রাতের এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন একজন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না স্থানীয়রা।
নিহতরা হলেন- নিশিন্দারা চকরপাড়ার শরিফ (২০) ও রুমন (২৩)। আহত হোসেন আকন্দ (১৯) একই এলাকার বাদল আকন্দের ছেলে।
নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, বগুড়া জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপু প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তাদেরকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন।
সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুর পরিবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার বিকালে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘটনার কারণ এখনও পরিষ্কার না। যেসব অভিযোগ এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন সকাল-সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, ঘটনার সূত্রপাত সোমবার ঈদুল আজহার রাত ১১টা থেকে ১২টার দিকে।
তারা বলছেন, ওই সময় বগুড়া শহরের গোয়ালগাড়ি এলাকায় একমুখী সড়কে কালো রঙের প্রাইভেটকারে সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুর মেয়ে ও ভাতিজা যাচ্ছিলেন। এ সময় উল্টো দিক থেকে দুটি মোটরসাইকেল দ্রুত গতি আসছিল। মোটরসাইকেল দুটির সঙ্গে গাড়িটির ধাক্কা লাগার মতো অবস্থা হয়। পরে মোটরসাইকেল আরোহীরা হাকির মোড় এলাকায় যান। সেখানে টিপুর মেয়ে ও ভাতিজার সঙ্গে কয়েকজন যুবকের বাগবিতণ্ডা হয়। পরে ওই যুবকরা চলে যান।
নিশিন্দারা চকরপাড়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সার্জিল টিপু, তার ভাই সৈয়দ কবির আহমেদ মিঠু ২৫-৩০ জন লোক নিয়ে নিশিন্দারা চকরপাড়া এলাকায় যান। তারা সেখানে গিয়ে শরিফ, রুমন ও হোসেনকে বাসা থেকে ডেকে নেয়। এরপর রাত ১টার দিকে গলির ভেতরে শরিফ ও রুমনের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। হোসেন তখন দৌড় দিয়ে পালাচ্ছিল। হোসেনকে হাসপাতালে চিকিৎসার দেওয়ার পর ঘটনা জানতে পারেন হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা।
হোসেন আকন্দবলেন, “ঈদের রাতে এলাকায় শিক কাবাবের আয়োজন ছিল। শিক কাবাব খেয়ে আমি বাসায় চলে আসি। রাতে আবার ফোন করে ডাক দেয়। তখন রাস্তায় গেলে দেখি পাঁচ-ছয়টি মোটরসাইকেলে অনেকজন হট্টগোল করছে। সেখানে সাবেক কাউন্সিলর টিপু ছিলেন।
“আমরা গেলে আমাদের দিকে এলোপাতারি গুলি করে। গুলি করার পরপরই আমি দৌড় দেই। কিন্তু কেন আমাদের ওপর হামলা তার কিছুই জানি না।”
হোসেন আকন্দের বাবা বাদল আকন্দ বলেন, “রাতে টিপুর সঙ্গে আরও লোকজন ছিল। তিনি গুলি করেছেন। তার লোকজন শরিফ ও রুমনকে খুন করেছে। আমার ছেলের যদি দোষ থাকে তার অবশ্যই বিচার হবে। কিন্তু তাদেরও বিচার করতে হবে।”
নিহত শরীফের মা হেনা বেগম বলেন, “টিপুর মেয়ে যে গাড়িতে যাচ্ছিল সেই গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগছে। হয়তো সেখানে আরও কিছু হয়েছে। আমি জানি না। কিন্তু এ জন্য রাতে টিপু, তার ভাই মিঠু লোকজন নিয়ে এসে আমার ছেলেকে ফোন দেয়।
“ফোন দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। পরে রাতে আশেপাশের বাড়ির লোকজন জানায়, আমার ছেলের লাশ বাগানের পাশের গলিতে পড়ে আছে।”
শরীফের বোন নীলা বলেন, “ওরা (টিপু ও তার লোকজন) রাতে এলাকায় আসছে। অনেকগুলো গুলি করছে, ওদের মারছে। সবাই শুনছে। কিন্তু কেউ বাড়ি থেকে বের হয়নি।”
শরীফ ও রুমনকে যেখানে হত্যা করা হয় তার ২০ মিটার দূরেই রুমনের নানা বাড়ি। সেখানেই রুমন থাকতেন।
রুমনের নানা শরিফুল ইসলাম বলেন, “ও ছোটবেলা থেকে আমার কাছে মানুষ হয়েছে। আমার ডাক্তারি পেশা আছে। সেখানে রুমন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত কাজ করে। গতকাল আমি রাত ১০টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। তখনও ও বাইরে ছিল।
“ঈদের দিন অন্যদের মতো সেও ঘুরে বেড়াচ্ছিল বলে আমি তেমন কোনও চিন্তা করিনি। রাতে হঠাৎ কয়েকটি গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর একজন বাসার গেটে এসে আমাকে ডাক দেয়। আমি তখন খুলিনি। আরও পরে স্থানীয়দের ডাকে বের হলে তারা জানায়, রুমনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে সৈয়দ সার্জিল আহমেদ টিপুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। উপশহর এলাকার তার বাসায় খোঁজ নিলে জানানো হয়েছে, টিপু সকালে থেকে বাড়িতে নেই।
পুলিশ রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে। তাদের শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
বগুড়া সদর থানার ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ জানিয়েছেন, ঘটনার কারণ নিয়ে পুলিশের কাছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আসছে।
তিনি বলেন, “সবগুলো আমরা আমলে নিয়ে এগোচ্ছি। নিহতদের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফন করবে পরিবার। তারপর আমাদের কাছে মামলার বিষয়ে আসতে চেয়েছে। তাদের স্টেটমেন্টের ওপর ভিত্তি করে আমরা অভিযোগ নিব। এ ঘটনায় ওই এলাকার একজন আহত রয়েছে।”
ঘটনার কারণ জানতে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলেও জানান বগুড়া সদর থানার ওসি।