Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

আনন্দের রথযাত্রা যেভাবে বিষাদের শবযাত্রা

রথের গম্বুজটি ওপরের বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে গিয়েছিল।
রথের গম্বুজটি ওপরের বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে গিয়েছিল।
[publishpress_authors_box]

“রথের গাড়িটি টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় চূড়াটি ১১০০ ভোল্টের তারে বেঁধে আগুন জ্বলে উঠে। আমি ওই সময় ছবি তুলছিলাম। আগুন দেখে আমরা সবাই চিৎকার দিয়ে উঠি”- বলছিলেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ৩১ ব্যাচের শিক্ষার্থী উদয় পাল। রথযাত্রার শুরু থেকেই তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

রবিবার বিকালে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ির আমতলার মোড়ে এ দুর্ঘটনায় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান তিন নারীসহ পাঁচজন। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এখন ৪০ জন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আনন্দের উৎসব এই রথযাত্রা। তবে বগুড়ায় আনন্দের এই উৎসব পরিণত হয়েছে বিষাদে।

আশেপাশে কয়েকটি জেলার মধ্যে বগুড়াতেই রথযাত্রার আয়োজন করে জেলার সেউজগাড়ি এলাকায় অবস্থিত ইসকন মন্দির। রথযাত্রাটি ইসকন মন্দির থেকে রওনা দিয়ে শহরের লতিফপুর এলাকায় অবস্থিত শিব মন্দিরে অবস্থান নেয়। নয় দিন পর উল্টো যাত্রায় সেউজগাড়ির ইসকন মন্দিরে ফিরে রথটিকে ফিরিয়ে আনার কথা।

উদয় পাল জানান, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্ঘটনাটি ঘটে য়ায়। রথের গাড়িটি থামাতে থামাতেই অনেকেই রাস্তার ওপর লুটে পড়ে। তারপরেও রথের রশি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অনেকে। কারণ দূরে থাকা অধিকাংশরা ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতেই পারেনি।

আমতলা মোড়ে ১১০০ ভোল্টের তিনটি তার রাস্তার এপাড় থেকে ওপাড়ে ঝোলানো আছে। রবিবার যাত্রার শুরুতেই রথের চূড়া বেঁধে যায় সেই তারে। ধাতব বস্তু দিয়ে তৈরি রথের গাড়ি ও চূড়া বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শে আসামাত্র রথটিকে ধরে থাকা অসংখ্য মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।

আহতের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলেও পাঁচজনকে বাঁচানো যায়নি। বগুড়া মেডিকেলে মারা যান জেলার শাহজাহানপুরের গোহাইলের রঞ্জিতা (৬০), আদমদীঘির কুন্দগ্রামের নরেশ মোহন্ত (৬০), শিবগঞ্জের কুলু পাড়ার অলোক কুমার (৪২), শহরের তিনমাথা রেলগেট এলাকার আতশী (৪০)।

বগুড়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে মারা যান সারিয়াকান্দি উপজেলার জলি রানী দাস (৩৫)।

রবিবার রাতে শজিমেকের তিনতলার আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট) সামনে বসে ছিলেন আজিজুল হক কলেজের সম্মান প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর কুমার রায়। তার রুমমেট সুমন কুমারের দাদি জোৎস্না বালা (৬০) গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। জোৎস্না বালা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বৈরাগির বাজার এলাকার বাসিন্দা।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, তারা মোট ৩৭ জনকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুজনকে আইসিউতে নেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চারজনকে ভর্তি করা হলে সেখানে একজন মারা যান। তিনজন এখন সেখানে চিকিৎসাধীন।

অন্তর বলেন, বগুড়ার রথযাত্রায় বাইরের জেলার মানুষও অংশ নিতে আসে। সুমন বগুড়ায় পড়ালেখা করে বলে তার মা ও দাদি রথযাত্রায় এসেছিল।

“আমরা রথের গাড়ির ৫০ মিটারের মধ্যে ছিলাম। দাদিরা রথের গাড়ির কাছেই ছিল। রথের গাড়িটি কাঠ, স্টিল দিয়ে তৈরি। চূড়াটিও স্টিলের। স্টিলের হওয়ার কারণে মানুষজন সহজেই বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে।”

রথযাত্রায় এমন দুর্ঘটনার জন্য স্থানীয়দের অনেকেই ইসকন মন্দিরের আয়োজকদের দুষছেন। তাদের অভিযোগ, আয়োজকদের গাফিলতির জন্য এমন ঘটনা ঘটে। রথের গাড়িটি যাওয়ার পথে কোথাও বাধবে কি না, তা আগেই দেখা উচিৎ ছিল।

বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে আহতদের নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে।

রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে গুরুতর আহত সেউজগাড়ির রঞ্জন কুমার পালের ভাই বিমান কুমার পাল বলেন,  “রথের চূড়া এর আগে কখনও এত বড় ছিল না। এবারই এত বড় করা হয়েছে। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতা ছিল সম্ভবত। খেয়াল করা উচিৎ ছিল, যাওয়ার পথে কোনও অসুবিধা হবে কি না? সেসবের কিছুই করেনি।”

বিমানের ভাই রঞ্জন এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তার বুক, পেট ঝলসে গেছে। আইসিইউতে আছে। তবে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া লাগতে পারে। 

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রথের গাড়িটির উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট। তবে বিশেষ কায়দায় গাড়িটি ফোল্ডিং (ভাঁজ) করে তিন ভাগের এক পরিমাণ উচ্চতায় আনা যায়। রথযাত্রার সময় গাড়িটি ৩০ ফুট উচ্চতায় ছিল।

ইসকন বগুড়া শাখার অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণ দাস বলেন, “রাস্তায় তার থাকবেই। তারের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় রথের গম্বুজটি নামানোর কথা ছিল। এজন্য আমাদের লোকজনও ছিল। ঘটনার আগে রথযাত্রায় প্রচুর ভিড় ছিল। আমি বারংবার গম্বুজটি নামাতে বলেছিলাম। কিন্ত আমার কথা কেউ শোনেনি।”

বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, রথযাত্রার এই দুর্ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল কায়েসকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

আহতদের চিকিৎসার যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত