অধিবর্ষ হওয়ায় এবার অমর একুশে বইমেলা ছিল ২৯ দিনের। ২৯তম দিনটি বৃহস্পতিবার হওয়ায় প্রকাশকদের দাবি ছিল মেলার সময় বাড়িয়ে শনিবার পর্যন্ত নেওয়ার।
সেই দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অনুমোদনে বইমেলার সময় দুদিন বাড়ানো হলেও বিক্রির ক্ষেত্রে আশা মেটেনি প্রকাশকদের।
প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা বলছেন, মেলা সময় বর্ধিত হওয়ার তথ্য ঠিকভাবে প্রচার হয়নি, মানুষ জানেই না যে মেলার সময় বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের প্রভাবও পড়েছে মেলায়।
মাসব্যাপী এই মেলায় সপ্তাহে দুদিন শুক্রবার ও শনিবার ছিল শিশুপ্রহর। তবে বর্ধিত সময়ের এই দুদিন ছিল না কোনো শিশুপ্রহর। মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায় আর শেষ হয় রাত ৯টায়।
শনিবার মেলার শেষ দিন অন্য ছুটির দিনের মতো ভিড় দেখা যায়নি। দর্শনার্থী কম থাকায় বিভিন্ন স্টলের কর্মীদের মধ্যে ছিল স্টল গোটানোর আগে বই গোছানোর তোড়জোড়।
আগামী প্রকাশনীর মালিক ওসমান গণি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি চিন্তা করে মেলা বাড়ানোর দাবি করা হয়েছিল। সেই দাবি পূরণ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আশা পুরণ হয়নি। শুক্রবার হিসেবে গতকাল দর্শনার্থীই ছিল না। আজ তো আরও কম। বিক্রিও নেই।”
প্রথমা প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী সোহেলও বলছিলন একই কথা। তার মতে, দুদিন সময় নষ্ট হলো আসলে।
তাম্রলিপি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী সুমি আক্তার বলেন, “মানুষ তো জানেই না মেলা দুদিন বাড়ছে। না জানলে আসবে কী করে?”
ঐতিহ্য প্রকাশনী ও কথা প্রকাশের বিক্রয়কর্মীরাও একই হতাশার কথা জানান।
ঝুমঝুমি প্রকাশনীর মালিক শায়লা রহমান তিথি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যারা অবগত যে মেলার সময় বেড়েছে, আসার ইচ্ছাও তাদের হয়ত ছিল, কিন্তু বেইলি রোডের মর্মান্তিক ঘটনায় যে শোক, তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।”
স্বল্প দর্শনার্থীর ভিড়ে পাওয়া গেল তামজিদ হাসান নামে এক তরুণকে। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “টিএসসি এসেছিলাম আড্ডা দিতে। এসে দেখি মেলা এখনও আছে। আর লোকজনও নেই। ঠেলাঠেলি কম। ভাবলাম একবার ঢু মেরে এক-দুইটা বই কিনে নেওয়া যাবে।”
শেওড়াপাড়া থেকে স্ত্রীকে নিয়ে বই কিনতে আসা ইমরান হোসেন বলেন, “এই নিয়ে দুবার এলাম। প্রথমবারের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। সেল্ফিবাজদের যন্ত্রণায় বই দেখার সুযোগ ছিল না। আজকে ভিড় নেই। তবে যেকজনই আছেন তারা সত্যিকারে বই কিনতে বা বই দেখতেই এসেছেন।”
বিক্রি ৬০ কোটির বেশি
এবারের মেলায় ৬০ কোটির বেশি টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ১৩ কোটি টাকা বেশি।
তবে বই প্রকাশের সংখ্যা আগের মতোই রয়েছে। এবার প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি নতুন বই। গতবছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭৩০টি।
শনিবার বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে এতথ্য জানান বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক শাহেদ মমতাজ৷
গত কয়েক বছরে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে আনুমানিক ৪৭ কোটি, ২০২২ সালে সাড়ে ৫১ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
কোভিড মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালে ৩ কোটি ১১ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। তবে ২০২০ সালে ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সম্মানীয় অতিথি ছিলেন নতুন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।
কামাল নাসের বলেন, “সারা পৃথিবীর ঘুরে এমন একটি বইমেলা কেউ খুঁজে পাবেন না৷ এই বইমেলা আমাদের আবেগের এবং জাতিসত্তার মেলা৷ যুগ যুগ ধরে এই মেলা বেঁচে থাকবে হাজারো মানুষের মাঝে।”
প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার বক্তব্যের শুরুতে বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণ করেন।
নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি কোনও প্রতিশ্রুতি করতে চাই না৷ আমি কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই।”
বইমেলা না সরিয়ে এখানেই রাখার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন তিনি।
সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্পন্ন সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ পুরস্কার দেওয়া হয়।
বইমেলায় নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট), বেঙ্গল বুকস (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়।
এছাড়া ২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস: বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত’ গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস প্রকাশনীকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়।
শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে ২০২৩ এ গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয় ময়ূরপঙ্খিকে।