দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের তথ্যে বড় পরিবর্তন এসেছে। এতদিন উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে দেখা দিয়েছে উদ্বৃত্ত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হিসাবায়নে সংশোধন এনে নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে সব তথ্য ওলটপালট হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩ জুলাই বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) হালানাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত এপ্রিলে চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) ভারসাম্যে ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাব (ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে।
তবে আগের তথ্যে, মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাব ছিল উদ্বৃত্ত। আর ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছি ৫৭২ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২২৩ কোটি ডলার।
গেল অর্থবছরের নয় মাস অর্থাৎ জুলাই-মার্চ মাস পর্যন্ত এ চিত্র ছিল উল্টো। ওই নয় মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৭৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৯২৫ কোটি ডলার।
এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময় চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৮ কোটি ডলার।
নতুন হিসাবের ফলে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছর জুলাই-এপ্রিল সময় চলতি হিসাবে ঘাটতি কমেছে ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ।
আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ৩৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২২৩ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর একই সময় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৫৪ কোটি ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য নিয়ে হিসাব করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তথ্যে এই গরমিল দেখা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রপ্তানি আয়ের তথ্য দেবে কেবল এনবিআর।
এই সিদ্ধান্তের পর এপ্রিলের হিসাবায়নে সংশোধন আনা হয়। এতেই বিওপির তথ্য ওলটপালট হয়েছে।
ইপিবির হিসাবে, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি (৪৭.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
ইপিবি রপ্তানির যে তথ্য দিয়ে আসছে, সেখানে রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেই মূল্য হিসাবে নেয়। আর এনবিআর রপ্তানির আয় থেকে আমদানির মূল্য বাদ দিয়ে নিট রপ্তানির মূল্য হিসাব করে।
এই বিভ্রান্তি দূর করতে বেশ কিছুদিন ধরে আইএমএফ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। এজন্যই এপ্রিল থেকে বিওপি হিসাবায়নে সংশোধন আনে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। এনবিআর আর ইপিবি একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে।”
এসব বিষয় নিয়ে গত রবিবার (৭ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “আমরা দুইভাবে রপ্তানি করি। এর একটি হচ্ছে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র)। প্রথমে আমরা কাপড় ও সুতা আমদানি করি, তারপর রপ্তানি করি। এখানে মোট মূল্য এক্সপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। আবার আরেকটি হচ্ছে কাপড় ও সুতা বিনা মূল্যে ক্রেতারা পাঠিয়ে দেয়।
“যখন রপ্তানি হয়, ক্রেতারা আমাদের শুধু সিএমটি (কাটিং, মেকিং অ্যান্ড ট্রিমিং) পেমেন্ট করে। কিন্তু ইপিবি এখানে পুরো রপ্তানি মূল্য দেখিয়েছে। আমি মনে করি ইপিবি ভুল করেনি।”
তবে দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত তথ্য। প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়টি আমরা বলে আসছিলাম।
“বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যৌক্তিক। সঠিক হিসাব না দেওয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
ফলে জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে ২২৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
বৈদেশিক আর্থিক সম্পদ ও দায় বিবেচনায় নিয়ে দেশের আর্থিক হিসাব গণনা করা হয়। এর মধ্যে থাকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ, অন্যান্য বিনিয়োগ ও রিজার্ভ সম্পদ। বিনিয়োগের ধারা (সম্পদ ও দায়), বিনিয়োগের দলিল (ইক্যুইটি, বন্ড, নোটস ও ঋণ) এই হিসাবের আওতায় আসে।
বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদের প্রথম অর্থবছরে (২০০৯-১০) আর্থিক হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চে ঘাটতি তৈরি হয়, যা গত মার্চ পর্যন্ত চলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এত দিন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর রপ্তানির তথ্য ধরে হিসাব করা হতো। কিন্তু ইপিবির হিসাব অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এ নিয়ে দেশি ও বিদেশি নানা সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এত পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে আয় বেশি আসার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে চলে গেছে। ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে দেশে আমদানি হয়েছে মোট ৫ হাজার ২৩৭ কোটি (৫২.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য।
এ হিসাবে বাণিজ্যে ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি (১৮.৬৯ বিলিয়ন) ডলার। জুলাই-এপ্রিল- এই দশ মাসে সেবা খাতে ঘাটতি ছিল ৩০৫ কোটি (৩.০৫ বিলিয়ন) ডলার। আর প্রাথমিক আয়ে ঘাটতি হয়েছিল ৩৫৯ কোটি (৩.৫৯ বিলিয়ন) ডলার।
তবে একই সময়ে দেশে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৯১১ কোটি (১৯.১১ বিলিয়ন) ডলার। এতে সব মিলিয়ে ওই সময়ে চলতি হিসাবে ৫৭২ কোটি (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার ঘাটতি তৈরি হয়।
মূলত রপ্তানি তথ্যের কারণে হিসাব ওলটপালট হওয়ায় বদলে গেছে দেশের লেনদেন ভারসাম্যের চিত্র। ফলে জুলাই-এপ্রিল সময়ের সার্বিক হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৫৫৬ কোটি (৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এত দিন রপ্তানির ভুল তথ্য দেখিয়ে হিসাব করা হয়েছে। এটা আগেই ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, রপ্তানিকারকরা কতটা ভালো করছেন।
“এর মাধ্যমে আর্থিক হিসাব ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। এটা শুধু গণনার হিসাবে পরিবর্তন। এতে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে চলে গেছে। অর্থনীতি এখনও চাপের মধ্যে আছে।”
আইএমএফের চাপে সংস্থাগুলো সঠিক তথ্য প্রদান করা শুরু করেছে বলে জনিয়ে তিনি বলেন, “এর ফলে রপ্তানির হিসাব যত বড় করে দেখানো হত, আসলে রপ্তানি এত বেশি নয়। রপ্তানির হিসাব বেশি দেখানোর কারণেই চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত আসত।”
জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশে এফডিআই কমেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই দশ মাসে মোট এফডিআই এসেছে ৩৫৯ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ৩৭২ কোটি ডলার।
এদিকে চলতি জুলাই মাসের ৮ তারিখ পেরিয়ে গেলেও গত জুন মাসের রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেনি ইপিবি। তবে অন্য মাসগুলোতে সাধারণত ৫ তারিখের মধ্যেই আগের মাসের রপ্তানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করে আসছিল সংস্থাটি।