একটা পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা যাক। ১৯৮১ সালে লিভারপুলের পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে আর কেউ আটকাতে পারেনি। যার অর্থ দাঁড়ায়, ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার ফাইনাল ওঠা মানেই রিয়ালের শিরোপা। গত ৪৩ বছর ধরে এই গল্পই শুনিয়ে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ।
এই পরিসংখ্যান আমলে নিলে এ বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগও মাদ্রিদের অভিজাতদের জেতার কথা। ইতিহাসে আপনি অনুপ্রেরণা খুঁজতে পারেন, কিন্তু নিশ্চয়তা পাবেন না। তা না হলে ইতিহাস পাল্টানোর এত এত গল্প ক্রীড়াঙ্গনে পাওয়া যেত না। রিয়াল মাদ্রিদের ফাইনাল জেতার সেই ইতিহাস কি এবার পাল্টাবে? বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের স্বপ্নযাত্রায় কাটা পড়বে স্প্যানিশ জায়ান্টরা?
ফাইনাল এক ম্যাচের লড়াই। এই মঞ্চে যেকোনও কিছু ঘটতে পারে। ফেভারিট-তকমা এখানে খুব বেশি খাটে না। ফলে রিয়ালকে হারিয়ে ডর্টমুন্ড যদি চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় শিরোপা উদযাপন করে, সেটি মোটেও অঘটন হবে না। কারণ রিয়ালকে হারানোর ক্ষমতা এই ডর্টমুন্ডের খুব ভালোমতোই আছে।
ফাইনালের মঞ্চ সেই ওয়েম্বলি
১১ বছর আগে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ হাতছোঁয়া দূরত্বে ছিল ডর্টমুন্ডের। ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীনে জার্মান প্রতিপক্ষ বায়ার্নের বিপক্ষে দারুণ লড়াই করেও হারতে হয়েছিল তাদের। আরিয়েন রবেনের শেষ মুহূর্তের গোলে বেদনায় নীল হয়েছিল ডর্টমুন্ড। ২০১৩ সালের মতো এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের আয়োজক লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। ১১ বছর আগের দুঃখ ঘোচানোর সুবর্ণ সুযোগ জার্মান ক্লাবের সামনে।
একই মঞ্চে একই প্রতিপক্ষকে পেলে মন্দ হতো না। তবে সেমিফাইনালে বায়ার্নকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করেছে রিয়াল। ডর্টমুন্ড এখন ১৪বারের চ্যাম্পিয়নের বিপক্ষে লড়বে ওয়েম্বলির ফাইনালে। লন্ডনের এই মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগ হারের হতাশা আছে জার্মান ক্লাবের। তবে পারফরম্যান্সের দৃষ্টিতে ডর্টমুন্ড ছিল দুর্দান্ত। ওয়েম্বলির ওই ফাইনালে বায়ার্নকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল তারা। রবেনের গোলটির আগে ক্লপের দল আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছিল। ফলে ২০১৩ সালের ফাইনাল অনুপ্রেরণার জায়গা হতে পারে ডর্টমুন্ডের।
রয়েসকে বিদায় জানানোর উপলক্ষ
২০১৩ সালের ফাইনালে বায়ার্নের বিপক্ষে খেলা দুজন খেলোয়াড় আছেন এবারের লড়াইয়ে। সেই দুজনের একজন ম্যাট হামেলস, অন্যজন মৌসুম শেষে ডর্টমুন্ড ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া মার্সো রয়েস। ক্লাব ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচিত এই উইঙ্গারের বিদায়টা নিশ্চিতভাবেই শিরোপা দিয়ে রাঙাতে চাইবেন তার সতীর্থরা।
ডর্টমুন্ডে রয়েসের ৪২৮ ম্যাচের চেয়ে বেশি খেলেছেন কেবল তিনজন। ক্লাবটির সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় এই উইঙ্গার আছেন দ্বিতীয় স্থানে। তবে ক্যারিয়ারজুড়ে চোট বাধা হয়ে না দাঁড়ালে সর্বোচ্চ ম্যাচের সঙ্গে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটাও হয়তো নিজের করে নিতে পারতেন রয়েস।
ক্লাবের প্রতীক হয়ে ওঠা এই ফুটবলার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল দিয়ে শেষবার নামবেন ডর্টমুন্ডের জার্সিতে। এই উপলক্ষ রঙিন আলোয় ভরিয়ে দিতে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা তার সতীর্থদের।
ইউরোপে দাপুটে পারফরম্যান্স
চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের পথ মোটেও সহজ ছিল না ডর্টমুন্ডের। ‘গ্রুপ অব ডেথ’-এ তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ২০২০ সালের ফাইনালিস্ট ও লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেন্ত জার্মেই, প্রিমিয়ার লিগের দল নিউক্যাসল ও ইউরোপিয়ান জায়ান্ট এসি মিলান। পিএসজির বিপক্ষে হার দিয়ে ইউরোপ মিশন শুরু হলেও এদিন তেরজিচের দল ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধু নকআউট পর্ব নিশ্চিত করেনি, হয়েছে ‘এফ’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন।
See you in London 👋 pic.twitter.com/pQgxl11Fyz
— Borussia Dortmund (@BlackYellow) May 8, 2024
শেষ ষোলোতে মুখোমুখি হয় ডাচ ক্লাব পিএসভি আইন্দহোভেনের, যারা ওই সময় ডাচ লিগে হেরেছিল মাত্র এক ম্যাচ। যদিও দুই লেগ মিলিয়ে ৩-১ অগ্রগামিতায় কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে সমস্যা হযনি ডর্টমুন্ডের। শেষ আটের লড়াইয়ে আতলেতিকো মাদ্রিদকে টপকে পায় ৫-৪ গোলের অগ্রগামিতায়।
এরপর সেমিফাইনালের লড়াইয়ে আবারও প্রতিপক্ষ পিএসজি। দারুণ ছন্দে থাকা লুইস এনরিকের দলকে ধরা হয়েছিল পরিষ্কার ফেভারিট। কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে জার্মান ক্লাবটি সবাইকে ভুল প্রমাণ করে ২-০ গোলের অগ্রগামিতায় উঠে যায় ফাইনালে। গোটা টুর্নামেন্টে এমন দাপট দেখানো দলটি রিয়াল বাধা পেরিয়ে শিরোপা উদযাপন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শক্তিশালী রক্ষণভাগ
এবারের মৌসুমে ডর্টমুন্ডের সাফল্যের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রক্ষণভাগ। চলতি বছরের প্রতিযোগিতায় তারা ছয় ম্যাচে কোনও গোল হজম করেনি। আটকে দিয়েছিল পিএসজিকে, যারা ওই সময় ১০ ম্যাচে দিয়েছিল ১৯ গোল। সেমিফাইনালের দুই লেগেই আলো ছড়িয়েছিলেন হামেলস। সিগনাল ইডুনা পার্কের ম্যাচে হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়। আর পার্ক ডু প্রিন্সেসে নিকো শ্লটারবেকের সঙ্গে মিলে রক্ষণে দেয়াল তুলে রেখেছিলেন।
এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে ডর্টমুন্ডের সেন্টার-ব্যাক জুটি যেমন বল রিকোভার ও ট্যাকল জয়ে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোলও করেছে। সেমিফাইনালে হামেলসের গোলটাই ফাইনালে পৌঁছে দেয় জার্মান ক্লাবটিকে। এছাড়া তাদের গোলকিপার গ্রেগর কোবেলও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। এবারের প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ ৪২টি সেভ করে সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি।
জুড বেলিংহাম, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রোদ্রিগোকে নিয়ে গড়া রিয়ালের আক্রমণভাগ ঠেকাতে যেকোনও দলকেই কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে ডর্টমুন্ডের যে আঁটসাঁট রক্ষণ, তাতে কঠিন সময় পেতে যাচ্ছে রিয়ালের আক্রমণভাগ।
ফর্মে আছে আক্রমণভাগ
রক্ষণভাগ সামাল দিতেই তো হবে না, শিরোপা জিততে হলে মাঠে অন্য পাশেও কর্তৃত্ব থাকা চাই। ডর্টমুন্ডের এই দলটির আক্রমণভাগও রয়েছে দুর্দান্ত ফর্মে। রিয়াল মাদ্রিদের রক্ষণভাগের পরীক্ষা নিতে তৈরি জার্মান ক্লাবের ফরোয়ার্ড লাইনআপ।
আক্রমণভাগের নেতৃত্বে নিকলাস ফুলক্রুগ। চ্যাম্পিয়ন লিগে তার গোল তিনটি, তবে গোলমুখে তিনি অনেক বলের জোগান দিয়েছেন। তার সঙ্গে জেডন সানচো আছেন দারুণ ফর্মে। এছাড়া রিয়ালের রক্ষণে ঝড় তোলার অপেক্ষায় রয়েস, জুলিয়ান ব্রান্ড, ডনিয়েল মালেন ও করিম আদেয়েমি।
এবারের চ্যাম্পিয়ন লিগে ডর্টমুন্ডের ১২ জন খেলোয়াড় গোল পেয়েছেন। অর্থাৎ, কোনও একজনের ওপর নির্ভরশীল নয় দলটি। প্রয়োজনের সময় যে কেউ পাল্টে দিতে পারেন দৃশ্যপট। গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান।