হলিউডের স্বর্ণযুগে সিনেমা দেখার একমাত্র জায়গা ছিল মুভি থিয়েটার। তাই মুভি থিয়েটারে ফ্লপ করলে তার আর ঘুরে দাঁড়ানোর কোন সুযোগই ছিল না। একবার ফ্লপ মানে তো সারাজীবন ফ্লপ। বাজেট ফিরে পাওয়ার কোনও সুযোগও ছিল না। তবে গত শতকের আশির দশকে এসে এই চিত্র খানিকটা পালটে যায়। সে সময় ভিএইচএস এসে ফ্লপ সিনেমাগুলোকে দেয় লগ্নিকৃত টাকা ফিরে পাবার সুযোগ। যেন বা দ্বিতীয় জীবন। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে দেখা যেত ভিএইচএস এর ক্যাসেট বিক্রির দোকান।
বর্তমানে এই একই কাজটি করছে নেটফ্লিক্স। হলিউডের কোন কোন ফ্লপ ছবি এখানে এসে হয়ে যাচ্ছে হিট। বলে রাখা ভালো, নেটফ্লিক্সে কোন গ্রাহকের ভিউ তখনই হিসেবের মধ্যে রাখা হয় যখন তিনি কোনও নির্দিষ্ট টিভি সিরিজ ও মুভির অন্তত ৭০ শতাংশ দেখেন।
তেমনই কিছু বক্স অফিস ফ্লপ কিন্তু নেটফ্লিক্স হিট হলিউড মুভি নিয়েই এই লেখাটি-
ম্যাডাম ওয়েব
১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই ছবিটি নিয়ে হলিউডে কম ঠাট্টা মশকরা হয়নি। বক্স অফিসে মাত্র ১০০ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার ব্যবসায় করেছে যে এই ছবি!
মারভেলের জনপ্রিয় কমিক চরিত্র স্পাইডার ম্যান সিরিজের এক পার্শ্ব চরিত্র ম্যাডাম ওয়েব। গল্পে যার মূল পরিচয় একজন প্যারামেডিক হিসেবে, যার নাম কাসান্দ্রা ওয়েব। যে কিনা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। কাসান্দ্রা ওয়েব চরিত্রে অভিনয় করছেন হলিউড অভিনেত্রী ডাকোটা জনসন।
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার পর মাসখানেক পর নেটফ্লিক্সে অভিষেক হয় এই সিনেমাটির। আর অভিষেকের অল্প কদিনেই তর তর করে বাড়তে থাকে এর ভিউ। অভিষেকের প্রথম সপ্তাহেই নেটফ্লিক্সে ১০ দশমিক ৮ মিলিয়ন বার দেখা হয়ে যায় ‘ম্যাডাম ওয়েব’। আর দখল করে নেয় প্ল্যাটফর্মটির সবচেয়ে বেশি দেখা সিনেমাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান।
অ্যাসাসিনস ক্রিড
দর্শক প্রিয় হতে ‘অ্যাসাসিন ক্রিড’ এর লেগেছে ৭ বছর! জনপ্রিয় ভিডিও গেইম ‘অ্যাসাসিন ক্রিড’ অবলম্বনে নির্মিত হয় এই সিনেমাটি। হলিউডে রিলিজ পায় ২০১৬ সালে। কিন্তু ভিডিও গেইমের জনপ্রিয়তার লেশমাত্র ধরে রাখতে পারেনি এই সিনেমা। অনেক আশা নিয়ে থিয়েটারে মুক্তি পেলেও হতাশ হতে হয় এর কলা-কুশলীদের। কারণ ১২৫ মিলিয়ন বাজেটের এই ছবিটি মাত্র ২৪০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। এর মধ্যে দুঃসংবাদ হয়ে আসে এর বিপণন প্রতিষ্ঠান টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের লোকসানের খবর। এই সিনেমার বিপণনে প্রতিষ্ঠানটির ১০০ মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়।
কিন্তু সাত বছর পর হিসেব পালটে যায়। ২০২৩ সালে এই সিনেমা নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। মুক্তির পর নেটফ্লিক্সের বেশকটি আঞ্চলিক টেরিটরির সেরা ১০ সিনেমার মধ্যে ঢুকে যায় অ্যাসাসিন ক্রিড। যাকে বলে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়া।
ব্লেন্ডেড
একটা সময় ছিল যখন অ্যাডাম স্যান্ডলার আর ড্রিউ ব্যারিমোর জুটি মানেই সিনেমা হিট। এই জুটির প্রথম দুটি সিনেমা অন্তত তাই ছিল। কিন্তু তিন নম্বরটাতে এসেই খেলো রাম ধরা!
২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই হলিউড মুভি থিয়েটারে রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়ে। বাজেটের চেয়ে মোটে ৬ মিলিয়ন ডলার বেশি আয় করে এটি।
এই সিনেমার বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ওয়ার্নার ব্রস। প্রতিষ্ঠানের ডমেস্টিক বিপণনের সভাপতি ড্যান ফেলম্যান মনে করেন, ‘স্পর্শকাতর দিনে’ সিনেমা মুক্তির তারিখ নির্ধারণ এর মূল কারণ। সিনেমাটি যেদিন মুক্তি দেওয়া হয় সেদিন ছিল আমেরিকার ‘মেমোরিয়াল ডে’। আর এই দিনে লোকজন নাকি তাদের পরিবার নিয়ে মুভি থিয়েটারে যাওয়ার কোনও আগ্রহ পায়নি।
কিন্তু দান উলটে যায় ১০ বছর পর। ২০২৪ এর মে মাসে এই সিনেমা নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে দ্রুত পরিণত হয় ‘মোস্ট ওয়াচড মুভি’-তে। নেটফ্লিক্স আমেরিকার প্রথম পাঁচ ছবির কাতারে ঢুকে যায় এটি।
সিক্সটি ফাইভ
বক্স অফিস হিট অ্যাডাম ড্রাইভারের কাছে নতুন কিছু নয়। তার অভিনীত ‘স্টার ওয়ার্স: দ্য লাস্ট জেডি’ সারাবিশ্বে ১ দশমিক ৩৩৪ বিলিয়ন ডলার ব্যবসায় করে। পায় ২০১৭ এর সবচেয়ে বেশি ব্যবসায় সফল হলিউড সিনেমার তকমা।
তবে ২০২৩ এর মার্চে মুক্তি পাওয়া ‘সিক্সটি ফাইভ’ অ্যাডাম ড্রাইভারকে দেয় বিপরীত অভিজ্ঞতা। ৪৫ মিলিয়নের এই সিনেমাটি মাত্র ৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যবসায় করে হতাশ করে সবাইকে। যদিও এই চিত্র বক্স অফিসের। অন্যদিকে মাত্র ৪ মাস পর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে দ্রুত নেটফ্লিক্সের ‘মোস্ট ওয়াচড’ মুভির দুই নম্বর স্থানটি দখল করে নেয়। অবশ্য তালিকায় ১ নম্বরে যেতে মাত্র দুই-তিন দিনই লেগেছিল।
দ্য স্নোম্যান
বক্স অফিস ফ্লপ, কিন্তু নেটফ্লিক্স হিট। মাইকেল ফ্যাসবেন্ডারের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে অন্তত দুই বার। একবার ‘অ্যাসাসিন ক্রিডে’ অভিনয় করে, আর একবার এই পুলিশ থ্রিলার ‘দ্য স্নোম্যান’এ।
‘দ্য স্নোম্যান’ নিয়ে ফেসবেন্ডার ছিলেন বেশ আশাবাদী। কারণ এই সিনেমাটি যে বেস্ট সেলিং তকমা পাওয়া একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত!
৩৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই ছবিটি মাত্র ৪৫ মিলিয়ন ডলার ব্যবসায় করে। তবে থিয়েটারে মুক্তির (২০১৭) ৬ বছর পর ২০২৩ সালের এপ্রিলে এটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। আর খুঁজে পায় সবচেয়ে বেশিবার দেখা সিনেমার মধ্যে বরাবর এক নম্বর স্থানটি।
দ্য লিটল থিংস
জন লি হ্যানককের ‘দ্য লিটল থিংস’ বক্স অফিসে দেখে ভয়াবহ বিপর্যয়। ৩০ মিলিয়ন বাজেটের এই সিনেমাটি আয় করে মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হয়, ২০২১ সালে মুক্তি এই সিনেমাটি কোভিড মহামারীর কারণে ব্যবসা করতে পারেনি। তবে ডেঞ্জেল ওয়াশিংটনের মতো নাম থাকার পরও এই সিনেমার এমন দশায় হতবাক হয়ে যান অনেকেই।
২০২৪ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর এই সিনেমা আমেরিকায় ১ দশমিক ৭ মিলিয়নেরও বেশি দেখা হয় এবং এই প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বেশি দেখা সিনেমার একটিতে পরিণত হয়।
ডাম্ব মানি
২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি বাজেটের বিপরীতে ১০ মিলিয়ন ডলার লোকসান করে। পায় সুপার ডুপার ফ্লপ ছবির তকমা।
তবে ঠিক একই সিনেমা ২০২৪ এর জানুয়ারিতে নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। পেয়ে যায় নেটফ্লিক্সের শীর্ষ ১০ সিনেমার তকমা। ফ্লপ সিনেমার পরিচালক ক্রেইগ গিলেস্পি নিশ্চয়ই এখন স্বস্তিতে আছেন।
ক্রিমসন পিক
বহু হিট সিনেমার পরিচালক গুইলারমো দেল তরোর ‘ক্রিমসন পিক’ মুভি থিয়েটারে আশানরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই গোথিক হরর সিনেমাটি ৫৫ মিলিয়ন বাজেটের বিপরীতে ৭৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার ব্যবসায় করে। যা গুইলারমোর নামের সঙ্গে বেশ বেমানান।
সাফল্য পেতে এই সিনেমাকে অপেক্ষা করতে হয় পাক্কা ৬ বছর। যখন এটি মুক্তি পায় নেটফ্লিক্সে। আর তারপরই সিনেমাটি এর পরিচালকের প্রতি যেন সুবিচার করতে পারে। মুক্তির পর মোস্ট ওয়াচড লিস্টে জায়গা পেয়ে যায় বেশ দ্রুত।
দ্য নাইস গাইজ
শ্যান ব্ল্যাক পরিচালিত ‘নাইস গাইজ’ মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। ৫০ মিলিয়নের এই সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করে ৬২ মিলিয়ন ডলার। রাসেল ক্রোর মতো তারকা আছেন যে সিনেমায়, সেই সিনেমার জন্য এই অঙ্ক বেশ বেমানান।
অনেকের মতে সাম্প্রতিক অতীতে মুক্তি পাওয়া হলিউড সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘নাইস গাইজ’ এর মতো ভালো ছবি খুব কমই আছে। তারপরও থিয়েটারে এমন ছবি কেন সাফল্যের মুখ দেখলো না তা অনেকের কাছেই বিস্ময় হয়ে আছে। ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তির আগ পর্যন্ত এই সিনেমা তার প্রাপ্য স্থানটি কখনোই খুঁজে পায়নি। এই স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তির পর ‘নাইস গাইজ; মাত্র একদিন সময় নিয়েছিল সেরার কাতারে যেতে। অর্থাৎ অর্ধযুগ লেগে গেল সিনেমাটির সাফল্য পেতে। তাও, পেল তো!
অ্যানায়হিলেশন
একঝাক তারকা সমৃদ্ধ ‘অ্যানায়হিলেশন’ হিট হবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ যে সিনেমায় একই সাথে নাটালি পোর্টম্যান, ওস্কার আইজ্যাক, এবং তেসা থমসন থাকবে তার গায়ে ‘হিট’ তকমা জুটবে এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা-না হয়ে সিনেমাটি ৪৩ মিলিয়ন ডলার বাজেটের বিপরীতে মাত্র ৫৫ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করতে পারে।
২০১৮- এর এই সিনেমাটির সব নাকি ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বেশ কয়টি পরীক্ষামূলক স্ক্রিনিং করে এর বিপণন প্রতিষ্ঠান প্যারামাউন্ট বেঁকে বসে। কারণ- পরীক্ষামূলক স্ক্রিনিং এর নেতিবাচক সমালোচনা। প্যারামাউন্টের পক্ষ থেকে বক্তব্য ছিল এই সিনেমা যথেষ্ট দর্শক মুভি থিয়েটারে টেনে আনতে পারবেনা। এই শঙ্কা থেকে প্যারামাউন্ট নেটফ্লিক্সের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রদর্শনের ব্যাপারে চুক্তি করে। যদিও তা সিনেমা হলে মুক্তির ১৭ দিন পর। অবশেষে ২০২৩ সালে ‘অ্যানায়হিলেশন’ নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে সিনেমা হলের বিপরীত চিত্রই দেখা যায়। নেটফ্লিক্সে এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের দর্শকদেরই পছন্দের তালিকায় স্থান পায়নি, পাশাপাশি নেটফ্লিক্স আমেরিকার টপ টেনে স্থান পায়।
তথ্যসূত্র: সিবিআর ডটকম।