গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উপর। প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বিক্রি আগের চেয়ে অনেক কমেছে। ইসরায়েলের মিত্র হওয়ায় তাদের এই সংকটে পড়তে হয়েছে বলে মনে করছেন ব্র্যান্ড সংশ্লিষ্টরা।
বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে একটি ম্যাকডোনাল্ডস। কোম্পানিটি তাদের পণ্য বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তাদের পণ্য বয়কটের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি কোম্পানিটির।
ম্যাকডোনাল্ডসের কর্মকর্তারা গত সোমবার জানান, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ওই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, চীন ও ভারতে বিক্রির প্রবৃদ্ধি শূন্য ছিল দশমিক ৭ শতাংশ। এটি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
গাজা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব ফাস্ট ফুড কোম্পানি ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে, তাদের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ডস অন্যতম। কোম্পানিটির পণ্য বয়কট ও তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।
ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া ব্র্যান্ডগুলোর তালিকা এখনও সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। ২০০৫ সাল থেকে ইসরায়েলবান্ধব ব্র্যান্ডগুলোকে লক্ষ্য করে শুরু হওয়া বৃহত্তর বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংসনস (বিডিএস) প্রচারের অংশ এটি।
ম্যাকডোনাল্ডস
ফাস্ট ফুড জায়ান্ট ম্যাকডোনাল্ডসের উপর ইসরায়েল বিরোধীদের রুষ্ট হওয়ার কারণ আছে। ইসরায়েল যখন গাজায় নির্বিচারে হামলা করে তখন কোম্পানিটি হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনাকে বিনামূল্যে খাবার দিয়েছিল। এবারের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ২৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
গত অক্টোবর থেকেই বিশ্বে এই কোম্পানির পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে ম্যাকডোনাল্ডসের কমপক্ষে ৫ শতাংশ ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও চীনে বিক্রির লক্ষ্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অঞ্চলে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। একই সময়ে কোম্পানিটির বৈশ্বিক বাজারে বিক্রি বেড়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি আগের প্রন্তিকের (তিন মাস) চেয়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কম।
সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, বাহরাইন ও তুরস্কের ম্যাকডোনাল্ডস ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ইসরায়েলে বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার প্রচারে সাড়া দেয়নি। উল্টো তারা গাজার জন্য ৩০ লাখ ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ম্যাকডোনাল্ডসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ক্রিস কেম্পচিনস্কি। তার মতে, যুদ্ধ চলতে থাকলে কোম্পানি তেমন কোনও পরিবর্তন আশা করছে না। তিনি বলেন, “গাজায় যা ঘটছে তা অমানবিক। এটি ম্যাকডোনাল্ডসের মতো ব্র্যান্ডগুলোকে প্রভাবিত করে।”
স্টারবাকস
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কফিহাউজ চেইন- স্টারবাকস। গত সপ্তাহে স্টারবাকসের ব্যবসা খারাপ হওয়ায় তারা বার্ষিক বিক্রির পূর্বাভাস কমিয়েছে। এখন তারা বলছে, বিশ্বব্যাপী ও যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক বিক্রি ৪ থেকে ৬ শতাংশ বাড়বে। যদিও আগে তাদের আভাসে এর হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ বলা হয়েছিল।
স্টারবাকসের সিইও লক্ষ্মণ নরসিংহ সাংবাদিকদের বলেন, গাজা যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্রাহক ও বিক্রি কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিক্রি কমেছে। সেখানে সিয়াটলভিত্তিক কোম্পানিটিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন বিক্ষোভকারীরা।
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর একদিন পরই স্টারবাকসের কর্মীদের ইউনিয়ন ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সোশাল মিডিয়া এক্সে একটি পোস্ট দিয়েছিল। অবশ্য এক ঘণ্টার মাথায় পোস্টটি সরিয়ে ফেলা হয়। তখন থেকেই মূলত সমস্যার শুরু। যুক্তরাষ্ট্রে স্টারবাকসের ৩৬০টির বেশি শাখা রয়েছে।
স্টারবাকস তার ট্রেডমার্ক লঙ্ঘনের দায়ে আইওয়ার আদালতে ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মামলা করে। ইউনিয়নকে স্টারবাকসের নাম ও লোগো ব্যবহার বন্ধ করতে বলে প্রতিষ্ঠানটি। এই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম আরও নষ্ট হয়।
পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে স্টারবাকস কর্মীদের ইউনিয়নও প্রতিষ্ঠানটির লোগো ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে পেনসিলভানিয়ার একটি আদালতে মামলা করে। এতে তারা স্টারবাকসের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগও আনে। এছাড়া ইউনিয়ন থেকে তাদের কর্মীদের বেতন বৃদ্ধিসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠানটির উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইন্দোনেশিয়ার বহু মানুষ স্টারবাকস ও ম্যাকডোনাল্ডস বয়কট করেছে।
কোকা-কোলা
মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের ক্রসফায়ারে পড়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে পানীয় কোম্পানি কোকা-কোলার। ইসরায়েলে বোতল কারখানা স্থাপনের কারণে ১৯৬৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আরব লীগ বয়কট করেছিল প্রতিষ্ঠানটিকে। এখন আবার সোশাল মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে। গাজা যুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটি কোনও পক্ষ নেয়নি। কিন্তু অতীতে ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্যতার জেরে কোকা-কোলাকে চাপে পড়তে হয়েছে।
তুরস্কের পার্লামেন্টে গত নভেম্বরে গাজা ইস্যুতে তাদের সব দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকে কোকা-কোলার বোতল সরিয়ে ফেলতে ভোট হয়। দেশটিতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে কোকা-কোলার বিক্রি কমেছে ২২ শতাংশ।
ডমিনো’স
ইসরায়েলি সেনাদের বিনামূল্যে খাবার দিয়ে বিপাকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিৎজা কোম্পানি ডমিনো’স। এশিয়ায় গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি ৮ দশমিক ৯ শতাংশ কমেছে। ডমিনো’স এর অভিযোগ, মালয়েশিয়া তাদের ইসরায়েলের মিত্র হিসেবে উল্লেখ করার পরই বিক্রি কমেছে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের দপ্তর থেকে গত ডিসেম্বরে এক ঘোষণায় ইসরায়েলি মালিকানাধীন সব জাহাজকে তাদের বন্দরে নিষিদ্ধ করা হয়। দেশটির সঙ্গে মালয়েশিয়ার কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
ডমিনো’স এর নির্বাহী পরিচালক ডন মেইজ বলেন, “এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলো মার খাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের কারণে এমনটা হচ্ছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় বড় ধাক্কা খাচ্ছে ব্র্যান্ডগুলো।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা