“দেখুন বিগ ব্যাশ আর বিপিএল হয় একই সময়ে। তাহলে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা কীভাবে খেলবে বাংলাদেশে”-এবার বিপিএল খেলতে এসে বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার বেন কাটিং।
এই সূচিই বড় সমস্যা বিপিএলের। বিপিএলের পাশাপাশি একই সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আরব আমিরাতের আইএলটি-২০, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ২০। ২০২৩ ডিসেম্বরে শুরু হওয়া নিউজিল্যান্ডের সুপার স্ম্যাশের ফাইনাল হয়েছে ২৪ জানুয়ারি। পাকিস্তানের পিএসএল শুরু হবে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে।
এই পাঁচ লিগের চাপে বিপিএলের চ্যাপ্টা হওয়ার দশা। গত বিপিএলেও এসব লিগের সঙ্গে সূচি থাকায় তারকা ক্রিকেটাররা ছিলেন যাওয়া-আসার উপরে। কে কখন কোন দলে আসছেন, দুই-তিন ম্যাচ খেলে আবার উড়াল দিচ্ছেন-হিসেব রাখা কঠিন। দর্শকদের মনে দাগও কাটতে পারেননি কেউ।
পাকিস্তানের মোহাম্মদ রিজওয়ান তো ঢাকায় নেমেই হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে পৌঁছে কুমিল্লার হয়ে খেলেছিলেন ম্যাচ! এবারও পাকিস্তানিরা চলে যাবেন ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে। বিব্রতকর এই ব্যাপারটা এড়াতে পিএসএল ও বিগ ব্যাশ নিজেদের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি করেছে, একই সময়ে দুই টুর্নামেন্ট আয়োজন না করার। বিপিএলের কী সেই সামর্থ্য আছে?
ড্রাফটের বাইরের ক্রিকেটারে কর ফাঁকি
আইপিএলে ড্রাফটের বাইরের ক্রিকেটার খেলানোর সুযোগ নেই। বেশিরভাগ ক্রিকেট লিগেই মানা হয় এটা, ব্যতিক্রম বিপিএল। বিদেশি খেলোয়াড় নিবন্ধন উন্মুক্ত রাখা আর ড্রাফটের বাইরে থেকেও খেলোয়াড় আনার সুযোগ আছে এখানে।
তাই যে কোন সময় যে কোন ক্রিকেটার চলে আসেন বিপিএলে। গতবার খুলনা টাইগার্সের হয়ে খেলতে বিমানে উঠেছিলেন পাকিস্তানের নাসিম শাহ। বাংলাদেশে পৌঁছে তিনি হয়ে যান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের!
এভাবে যারা ড্রাফটের বাইরে থেকে আসেন, সুযোগ তৈরি হয় তাদের কর ফাঁকি দেওয়ার। কারণ বিসিবি ড্রাফটের বাইরের কোনো ক্রিকেটারের চুক্তি নিয়ে অবগতই নয়।
এর কারণ জানতে চাইলে বিসিবির মার্কেটিং অ্যান্ড কমার্শিয়াল ইনচার্জ ও বিপিএলের সমন্বায়ক সাইফুল আমিন জানিয়েছেন, ‘‘ফ্র্যাঞ্চাইজিরাই ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়ে আসে। কত ম্যাচের জন্য কোন ক্রিকেটারকে কত বেতন দেয়, এটা তারাই নির্ধারণ করে। একই সময়ে অনেক গুলো লিগ চলায় আমরা এতে বাঁধা দিই না। এমনিতে দেশী ক্রিকেটারদের কর দিতে হয় ১০-১২ শতাংশ আর বিদেশিদের কর ৩০ শতাংশ। তবে ড্রাফটের বাইরের ক্রিকেটারদের কর ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কত দেয় সেটা বিসিবির জানা নেই, ভালো বলতে পারবে এনবিআর।”
বিসিবি জানে না, মানেই কর ফাঁকির ক্ষেত্র তৈরি হওয়া। ড্রাফটের বাইরের ক্রিকেটারকে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্ধেক আর বাকিটা হাতে ধরিয়ে দিলেই তো কর ফাঁকি দেওয়ার পথটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
তৈরি হচ্ছে না খেলোয়াড়
১০ আসরে খেলেছে ২৮টি ফ্র্যাঞ্চাইজি! এজন্য চেন্নাইয়ের যেমন প্রতীক হয়ে গেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি বা বেঙ্গালুরুর বিরাট কোহলি-এমন কেউ নেই বিপিএলে। দলগুলোর থাকে না প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমও। অথচ ভারতের হার্দিক পান্ডে, রিংকু সিং, জাসপ্রিত বুমরাহ কিংবা পাকিস্তানের হারিস রউফরা উঠে এসেছেন ফ্র্যাঞ্চাইজিদের ট্যালেন্ট হান্ট থেকেই।
সিলেট স্ট্রাইকার্স এবার বোলার অন্বেষণ করলেও বিপিএলের দলগুলোর বেশিরভাগের তেমন কার্যক্রম নেই। সাইফ উদ্দিন, শেখ মেহেদি ও মুনিম শাহরিয়ার ছাড়া বিপিএল মাতিয়ে নতুন কারও জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার উদাহরণ নেই। নীচু বাউন্সের উইকেটে নীচু মানের ক্রিকেটও নতুন কারও উঠে না আসার অন্যতম কারণ।
বিশ্বকাপ সামনে রেখে এবার ব্যাটিং বান্ধব উইকেট তৈরি করেছে বিসিবি। মিরপুরের সেই উইকেটেও বলার মত রান নেই কারও। প্রথম ১২ ম্যাচ শেষে সর্বোচ্চ পাঁচ রান সংগ্রহকারী ব্যাটারের তালিকায় বাংলাদেশি ছিলেন তিনজন- মুশফিকুর রহিম (১৮০ রান), ইমরুল কায়েস (১৪৮) ও তামিম ইকবাল (১২৭)। অথচ মুশফিক আর তামিম অবসর নিয়েছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে। ইমরুল কায়েস জাতীয় দলের রাডারের ত্রিসীমানাতেও নেই। তাহলে নির্বাচকরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল গড়বেন কাদের নিয়ে?
তুলনায় সিলেটের উইকেট ভালো। এখানেও কেন রান পাচ্ছেন না দেশি ব্যাটাররা ? খুলনা টাইগার্সের কোচ তালহা জুবায়ের বিশ্লেষণ, ‘‘এবার সাত দলে ডেভ হোয়াটমোর ছাড়া সবাই দেশি কোচ। তবে ক্রিকেট কোচ নয়, ক্রিকেটারদের খেলা। বিপিএলের চাপটা আমাদের তরুণরা নিতে পারছে না। এটা শিখতে হবে প্রিমিয়ার লিগ থেকে।’’
জাতীয় দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশার বলেছেন দুটি শব্দে, যদিও এর ব্যাপকতা অনেক বেশি, ‘‘সামর্থ্য নেই।” এটাই হয়ত সত্যি। সামর্থ্য নেই বলেই আইসিসির বর্ষসেরা টি-টোয়েন্টি একাদশে যখন উগান্ডার ক্রিকেটার সুযোগ পায়, তখন বাংলাদেশের কেউ থাকে না। তাহলে ফি-বছর এই বিপিএল আয়োজন করে কী লাভ !
জুয়ার বাজার রমরমা
বৈশ্বিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলোর মতো বিপিএল এলেও দেশে অনানুষ্ঠানিক জুয়ার হুজুগ তৈরি হয়। তরুণরা স্মার্ট ফোনে জুয়ার সাইটে গিয়ে বাজি ধরছে হরহামেশা। গ্রাম-গঞ্জের চায়ের দোকানে দেখার যায়, বলে বলে বাজি ধরছে কিছু লোক।
সিআইডির সাইবার পুলিশ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ জুয়ার মতে, “জুয়ার বিভিন্ন সাইট বন্ধ করার পরও অন্তত ১০০টা সাইট সচল থাকে। কোনোভাবে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায় না। এভাবে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়।”
ঠিক কত টাকার অনলাইন জুয়া হতে পারে এবারের বিপিএলে? এমন প্রশ্নে রেজাউল মাসুদ জানালেন, ‘‘আমরা বেটউইনারে দেখেছি প্রতিদিন সেখানে বেটিং হয় ১ কোটি টাকা। তাহলে মাসে যায় ৩০ কোটি টাকা। এরকম ১০০টা ওয়েবসাইটে মাসে বেটিং হচ্ছে ৩০০০ কোটি টাকা। এবারের বিপিএলে মাঠে খেলা থাকবে ২৪ দিন। এই অঙ্কে অন্তত ২৪০০ কোটি টাকার বেটিং হতে পারে বিপিএলে।’’
তাই জুয়াড়িদের ফাঁদে পা না দিতে ক্রিকেটারদের অনুরোধ করে রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘‘সাকিব আল হাসান যখন বেটউইনার নিউজ পোর্টালের এম্বাসেডর হয়েছিলেন (বিসিবির চাপে সরে এসেছিলেন দ্রুতই) তখন ওদের ট্রানজেকশন অনেক বেড়ে গিয়েছিল এবং ওদের সার্ভার হ্যাং (স্থবির) হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু ক্রিকেটাররা সেলিব্রেটি এবং অনেকের স্বপ্নের নায়ক, তাই তারা যখন একটা কথা বলেন তখন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।”
বেটিং, বিসিবি ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের আইনে জুয়া খেলা তো বটেই, জুয়ার প্রচারণাও নিষিদ্ধ। এজন্য বিপিএলে কোন বেটিং সাইটের প্রচারণা নেই।
বিপিএল শুরুর আগে এ নিয়ে গভর্নিং কাউন্সিল সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক বলেছিলেন, ‘‘গত বছর বিপিএলে আমরা মিডিয়া রাইটস থেকে আরও ১০ কোটি টাকা বেশি পেতাম। শুধুমাত্র বেটিং সাইট চালানো বন্ধ করে দেয়ার কারণে কম পেতে হয়েছে। এখনকার সময়ে বেশিরভাগ জাতীয় দলই স্যারোগেট এলাও করে দিয়েছে। ২-১ টা ছাড়া সবাই এটা নিচ্ছে, ভারতও নিচ্ছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশে হবে কিনা, ভাবব।”
বিপিএলে না হলেও বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে বেটিং এর প্রচারণা অনুমোদিত। বাংলাদেশি ক্রিকেটাররাও করেছেন সেই প্রচার।
গত বছর জুলাই-আগস্টে কানাডার গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগে মন্ট্রিল টাইগার্সের হয়ে খেলতে নামা সাকিব আল হাসানের বুকে জ্বলজ্বল করেছে বাবু এইটিএইট স্পোর্টসের লোগো, যা বেটিং সংস্থার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। একই লিগে সারে জাগুয়ার্সের হয়ে খেলা লিটন দাসের জার্সিতেও শোভা পেয়েছে বেটিং সংস্থা ‘ব্যাটারি’র লোগো।
লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগের (এলপিএল) টাইটেল স্পন্সরই ছিল স্কাইফেয়ারডটনিউজ। এটা একটি বেটিং সংস্থার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। সেখানেও বেটিং সাইটের লোগো পড়ে খেলেছেন সাকিব আল হাসান, তাওহিদ হৃদয়রা।
এবারের বিপিএলেও দুর্দান্ত ঢাকার জার্সিতে ‘ক্রিকনিউজ’ লোগোর মাধ্যমে জুয়ার স্যারোগেট ব্র্যান্ডিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। বিসিবিও খতিয়ে দেখতে চেয়েছিল সেই অভিযোগ। তবে দুর্দান্ত ঢাকা আইনজীবীর মাধ্যমেই অস্বীকার করেছে সেটা।
পরিশেষে
বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কথা অনুযায়ী বিসিবিও এখন বেটিং সাইট নেবে কিনা ভাবছে। অর্থাৎ বিপিএলকে ঘিরে জুয়ার বাজার বড় হচ্ছে দিন দিন। কিন্তু এই টুর্নামেন্ট সেভাবে দিতে পারছে না ক্রিকেটকে। এক যুগেও ওরকম হার্ড হিটার জন্ম দিতে পারেনি, যার খ্যাতি ছড়িয়েছে বিশ্বময়।