Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

ব্রেইল পাল্টে দিচ্ছে জীবনের মানে

ব্রেইলে লেখা ‘সকাল সন্ধ্যা’, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে পারেন।
ব্রেইলে লেখা ‘সকাল সন্ধ্যা’, যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়তে পারেন।
[publishpress_authors_box]

একটি বোর্ডে চারকোনা খোপ খোপ করা। তার নিচে বিশেষ ধরণের কাগজ রেখে একটি চিকন ধাতু দিয়ে চেপে চেপে দিচ্ছিল তরিকুল ইসলাম নাজিম। লেখা শেষ হতে  সাদা কাগজটি তুলে ধরল সামনে। সাদা কাগজে  ফুটে উঠেছে কতগুলো উত্তল বিন্দু।

একটি ঘরে সর্বোচ্চ ছয়টি বিন্দুর নানা রকম সমন্বয়ে লেখা যায়। হাতে ধরা কাগজে কী লেখা রয়েছে?

কাগজের উপর আঙ্গুল রেখে ধীরে ধীরে পড়ে শোনালো তরিকুল ইসলাম নাজিম; ”সকাল সন্ধ্যা।”

২০১০ সালে ব্রেইলে হাতেখড়ি এই তরুণের। ব্রেইল তার আত্মপরিচয় পাল্টে দিয়েছে বলে জানালেন সকাল সন্ধ্যাকে।  

তরিকুল ইসলাম নাজিম বলেন, “বরিশালের একটা ব্লাইন্ড স্কুলে আমি ক্লাস থ্রি অব্দি পড়েছি। ব্রেইল শিখতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। আমার মোটামুটি সাত দিনের মত সময় লেগেছিল।

“তখন প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম তখন ভেবেছিলাম এটা কীভাবে শিখব। তো শিখে গিয়েছিলাম।”

পাঠ্যবইয়ের বাইরে সাহিত্যের বই হাতে আসে স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশনের হাত ধরে।

“২০১৭ সাল থেকে আমি স্পর্শের বই পড়ছি”, বললেন  তরিকুল ইসলাম নাজিম।

২০২৩ সালে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন এই তরুণ।

ব্রেইল দৃষ্টিহীনদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তালিকায় আনতে পেরেছে জানিয়ে  নাজিম বলেন,” ব্রেইল আমাদের কাছে চোখের জ্যোতির মত।

“কেউ যেমন চোখের আলো দিয়ে পড়ছেন, আমরাও তেমন হাতের স্পর্শে ব্রেইলে লেখা পড়ছি। নিজেকে দৃষ্টিজয়ী বলতে চাই … প্রতিবন্ধী শব্দটা শুধু বোঝার সুবিধার্থে।”

নাজিমের এই ’দৃষ্টিজয়ী’ হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে ব্রেইল।

তবে ‘যখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হচ্ছি তখন ব্রেইলে বই পাচ্ছি না- এটা আমাদের বড় অপ্রাপ্তির জায়গা’ বলেও জানালেন তিনি।

পাশাপাশি নাজিমের অভিমত, ব্রেইল  প্রশিক্ষণে মনিটরিং জরুরি। 

“আমি আমার জীবনে এমন এমন শিক্ষক পেয়েছি যারা ব্রেইলে অদক্ষ। তারা আসলে ব্রেইল পড়তেই পারেন না। এখন ক্লাস থ্রি বা ফোরের বাচ্চারা ব্রেইল বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। তারা টেকনলজির উপর নির্ভর করছে। এটা আমাদের জন্য একটা হতাশার জায়গা।”

নাজিমের ’দৃষ্টিজয়ী’ হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ব্রেইল

নাজিমের ভাষ্যে, “টেকনোলজি ও ব্রেইল ‍দুটোতেই আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে।”

মোটে পাঁচ বছর বয়সে ব্রেইল শিখেছিলেন মোহিনী আক্তার তামিম; তখন ছিল ২০১০ সাল।

“তখন আমি একটা স্কুলে ভর্তি হই। এক মাসেই মোটামুটি আমি ব্রেইল শিখি। এরপর টেক্সটবুক দিয়েই আমার ব্রেইল পড়া শুরু। ক্লাস সিক্সে আমি হাইস্কুলে ভর্তি হই। তখন থেকে আমার টেক্সটবুকের পাশাপাশি সাহিত্য বা অন্যান্য বই ব্রেইলে পড়া শুরু। স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।”

২০২৩ সালে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন মোহিনী আক্তার তামিম।

জীবনের ব্রেইলের প্রভাব নিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যার কাছে বলেন, “আগে মানুষের ধারণা ছিল আমরা জীবনে কিছু করতে পারবো না। এখন দিনে দিনে ধারণাটা পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের চিন্তা-ধারাও বদলে যাচ্ছে।

“ব্রেইলের মাধ্যমে আমরা জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছি। আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারছি।”

বিশ্বসাহিত্যের সাথে তার ব্রেইল দিয়েই পরিচয় ঘটে বলে জানালেন মোহিনী আক্তার তামিম।

“ব্রেইলে কিছু সাহিত্য পড়েছি। এরমধ্যে রয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমি তপু, দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন, আঁখি এবং আমরা কজন। কিছু অনুবাদ সাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের কিছু অমর সৃষ্টিও পড়েছি; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড়, নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি।”

ব্রেইলে আরও অনেক বই পড়ার ইচ্ছা রয়েছে জানিয়ে এই তরুণী বলেন, “আমার অনুবাদ সাহিত্য পড়তে ভালো লাগে। মার্থে মাকেনারের লেখা স্পাই গার্ল, জুলভার্নের লেখা আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ  বই দুটো আমার অসাধারণ লেগেছে।

“জুল ভার্ন এর মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড, ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা, রবিনসন ক্রুসো বইগুলো ব্রেইলে এলে আমার মত অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পাঠকরা খুব উপকৃত হবে।”

নাজিমের মত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সরকারি উদ্যোগে ব্রেইল বই না থাকা নিয়ে ‘হতাশা’ জানলেন মোহিনী।

এ নিয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যা ডটকমকে বলেন, “উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরই বইয়ের ব্যবস্থা করতে হয়, যা অনেক খরচ সাপেক্ষ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থীর জন্য এই ব্যয় কষ্টসাধ্য।”

জুল ভার্নের মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড ব্রেইলে পড়তে চান মোহিনী

মোহিনী বলেন, ব্রেইলের ’উপকরণগুলোর’ সহজলভ্য হওয়া জরুরি।

 “ব্রেইল লেখা চর্চার ক্ষেত্রে ব্রেইল পেপারের খুব সংকট ফেইস করতে হয়। সেক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় যদি আমাদের মত স্টুডেন্টদের তালিকা তৈরি করে প্রতি মাসে বা ছয় মাস পর পর নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্রেইল পেপার আমাদের প্রোভাইড করে সেক্ষেত্রে আমরা আমাদের লেখার চর্চাটা চালিয়ে যেতে পারি।”

মোহিনী ব্রেইলে লিখতে পছন্দ করেন। এর কারণও ব্যাখ্যা করেন তিনি সকাল সন্ধ্যা ডটকমকে। 

“উচ্চ মাধ্যমিক থেকে রেকর্ড নির্ভর পড়াশোনা করতে হয়। এতে অনেক সময় আমাদের ক্লান্তি চলে আসে।”

ব্রেইল লেখার কাগজ ও উপকরণ সহজলভ্য হলে ছড়া লেখার চর্চা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে জানালেন এই তরুণী।

মোহিনী বলেন, “ছোটবেলা থেকে ব্রেইলে লিখে বড় হয়েছি। আমি ছড়া লিখতে পছন্দ করি। কিন্তু ব্রেইল পেপারের অপ্রতুলতার কারণে চর্চাটা করা হয়ে ওঠে না। এই সুযোগটা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত থেকে যাই।

”প্রয়োজনীয় পেপার ও উপকরণ পেলে আশা করি এই সীমাবদ্ধতা থাকবে না।” 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত