Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

ব্রাজিলের গরু আসবে কি

brazil-cow-080424-03
[publishpress_authors_box]

আলোচনায় এখন ব্রাজিলের গরু, এর সূত্রপাত দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরোর সফরে। এক বৈঠকে তিনি গরুর মাংস রপ্তানির প্রস্তাব দেন। তখন তাকে আস্ত গরু রপ্তানির প্রস্তাব দেওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

দেশে মাংসের উচ্চ মূল্যের মধ্যে সংবাদমাধ্যমে এই খবর দেখার পর দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি থেকে জীবন্ত গরু আমদানির আলোচনা শুরু হয় সোশাল মিডিয়ায়। আসলেই কি আমদানি হচ্ছে গরু? সরকারের সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত? এমন সব প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি ব্রাজিলের গরু আনলে আর্জেন্টিনা সমর্থকরা খাবে কি না, তেমন সরস আলোচনাও চলছে। কারণ বিশ্ব ফুটবলে প্রতিবেশী এই দুই দেশের দ্বৈরথ বরাবরই আলোচিত।

এদিকে আমদানির খবরে উদ্বেগে পড়েছেন বাংলাদেশের খামারিরা। তারা বলছেন, গো খাদ্যের খরচ জোগাতে এমনিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তার ওপর আমদানি হলে তাদের ব্যবসার পথ থাকবে না।

বাংলাদেশে প্রথম সফরে এসে একদিন আগে রবিবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ব্রাজিলের মন্ত্রী মাউরো। পাশাপাশি তিনি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেই গরু নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “ব্রাজিল কম দামে মাংস উৎপাদন ও রপ্তানি করতে পারে। সে বিষয়ে তারা বলেছে। কোরবানি সামনে রেখে আমি বলেছি, সস্তা হলে লাইভ ক্যাটল (জীবন্ত গরু) আনার ব্যবস্থা করা যায় কি না? তারা দেখবে বলেছে।”

গরুর মাংসের উচ্চমূল্য নিয়ে দেশে অসন্তোষ ব্যাপক হলেও গৃহপালিত এই পশুর চাহিদায় ঘাটতি না থাকার কথা বরাবরই বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৭ লাখ। সংখ্যাগত দিক থেকে গরু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বাদশ।

কোরবানির ঈদের আগে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে কোরবানিযোগ্য পশুর হিসাব দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে প্রায় অর্ধ কোটি কোরবানিযোগ্য গরুর হিসাব দেওয়া হয়েছিল।

এক সময় দেশে চাহিদা মিটত ভারত থেকে আসা গরুতে। তবে দেশে উৎপাদন বাড়ায় চিত্র বদলে গেছে কয়েক বছর হলো।

বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৭০ হাজারে মতো। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে সংখ্যাটি লাখ ছাড়াবে।

রবিবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংব্দ সম্মেলনে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরো।

উদ্বিগ্ন খামারিরা

ব্রাজিল থেকে কোরবানি উপলক্ষে গরু আমদানির খবরে উদ্বিগ্ন খামারিরা বলছেন, যদি আমদানি হয়, তাহলে আসছে কোরবানির ঈদে তাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

ঢাকার মিরপুরের মোহনা এগ্রো অ্যান্ড ডেইরির মালিক আল মাহফুজ চয়ন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গরু লালন-পালনে খরচ অনেক। এমনিতেই গরুর খাবারের দাম অনেক বেড়েছে। এখন যদি ব্রাজিল থেকে বা বাইরে যে কোনও জায়গা থেকে গরু আসে, তাহলে তো আমাদের আর কিছু থাকবে না।”

খরচের কারণে খামারে গরু কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “গত কোরবানির সময় আমার ৫০টি গরু ছিল। কিন্তু এবার মাত্র ১০টি গরু তৈরি করেছি। লস দিয়ে এই ব্যবসা আর করা যাচ্ছে না।”

একই সুর সিরাজগঞ্জের শহীদ এগ্রোর মালিক তানভীর আহমেদের। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গরুর দাম কমানোর জন্য বিদেশ থেকে গরু আনতে হবে কেন? আপনি গরুর খাদ্যের দাম কমান। দেখেন কীভাবে গরুর দাম কমে। কেউ এটা নিয়ে আলাপ করছে না। মানুষের আলাপ শুনলে মনে হবে, সব দোষ খামারিদের।”

খামারিরা বলছেন, আগে ৩৭ কেজি ভূষির প্রতি বস্তার দাম ছিল ১ হাজার ৩০০ টাকা, এখন তা ২ হাজার ৫০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। ৩৭ কেজির ক্যাটল বুস্টার প্রতি বস্তার দাম ছিল ১ হাজার ৫০ টাকা, এখন তা ১ হাজার ৩৫০ টাকা। ৩৪ কেজি গমের বস্তা ছিল ১ হাজার ১০০ টাকা, তা এখন ১ হাজার ৬০০ টাকা। লবণের দামও ৫০ কেজির বস্তায় আড়াইশ টাকা বেড়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বললেন, চূড়ান্ত নয়  

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।

গরু আমদানি নিয়ে আলোচনার মধ্যে প্রতিমন্ত্রী টিটু সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নে জানালেন, এখনও কিছুই চূড়ান্ত হয়নি।

“গরু আনব, আনা হচ্ছে, এগুলো কিছুই না। এটা একটা আলোচনা শুধু। এটা সিরিয়াস কোনও বিষয় না, একটা চলমান আলোচনা শুধু।”

ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে গরুর বিষয়টি কীভাবে এলো, তার ব্যাখ্যা দিয়ে টিটু বলেন, গরুর মাংস রপ্তানিতে বিশ্বে শীর্ষে ব্রাজিল। তাই তাদের মন্ত্রী রপ্তানির প্রসঙ্গটি তোলেন।

“আমাদের মধ্যে আলাপ হচ্ছিল, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যে কী কী সম্ভাবনা আছে। আমাদের আলোচনায় ছিল গার্মেন্টস, জুট, ফার্মাসিউটিক্যালস এগুলো। আর ওরা যেহেতু মাংস ও পোল্ট্রি উৎপাদনে বিশ্ব শীর্ষে রয়েছে, তাই ওরা আমাদেরকে পুশ করছিল বারবার এনিমেল প্রোটিনের দিকে।

“আমি তখন তাদের ইনফরমালি বলেছিলাম, তোমরা মাংস পাঠাতে চাও, কিন্তু কেন জীবন্ত গরু না?”

ব্রাজিল কী চায়

গত বছর বিশ্বের ১২৬টি দেশে গরুর মাংস রপ্তানি করেছে ব্রাজিল। তারা তাদের ব্যবসা মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও ছড়াতে চাইছে।

সে কারণে তারা এই অঞ্চলে বাংলাদেশে মাংস প্রক্রিয়াজাত করণ ইউনিট গড়ে তুলতে প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওরা তো শুধু মাংস বিক্রি করে না, মাংস প্রক্রিয়া করে নানান জিনিস তারা তৈরি করে।

“ওরা ওদের মাংসের বাজার সেন্ট্রাল এশিয়া, সাউথ ইস্ট এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চায়। এরজন্য তারা আমাদের দেশে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের ইউনিট তৈরি করতে চায়।”

এক সময় গরুর মাংস আমদানি করত ব্রাজিল, এখন করে রপ্তানি।

আমদানিকারক থেকে এখন শীর্ষ রপ্তানিকারক

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে, সারাবিশ্বে ২০২০ সালে প্রায় ১৪৬ কোটি ৮০ লাখ গরু পালিত হয়েছে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৭ লাখ পালনের মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত ১৮ কোটি ৯০ লাখ, তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীন ১১ কোটি ৩৫ লাখ, চতুর্থ অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ৮ কোটি ৯২ লাখ ও পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইথিওপিয়ায় ৫ কোটি ৪০ লাখ গরু রয়েছে।

১৯৮০ সাল পর্যন্ত গরুর মাংস আমদানি করতে হত ব্রাজিলকে। কিন্তু ৯০ দশক থেকে প্রেক্ষাপট পাল্টাতে থাকে। গরু লালন পালনে প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ করা শুরু করে, যার ফলে উৎপাদনশীলতা, মাংসের গুণমান মান বাড়ে। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি হালনাগাদের মাধ্যমে তারা আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।

দেশটির অনুকূল জলবায়ু, জমির প্রাপ্যতা, পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি তাদের এই অবস্থায় পৌঁছতে সহায়তা করেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য প্রকাশ করে অনলাইনভিত্তিক প্রকাশনা আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা। তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে একটি গরু থেকে পাওয়া গড় মাংসের পরিমাণ ২১৮ কেজি। যেখানে বাংলাদেশে একটি গরু থেকে মাংসের পরিমাণ গড়ে মাত্র ৭১ কেজি। অন্যদিকে ব্রাজিলের গরু থেকে গড়ে মাংস পাওয়া যায় ৩৫১ কেজি।

বাংলাদেশে গরু উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্রাজিলের মডেলের দিকে চোখ রাখার কথা বললেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।

তিনি বলেন, “তাদের সাথে আমাদের বাণিজ্য শুরু হলে ওরা কীভাবে এই অবস্থায় গেল, তা আমাদের জানা সহজ হবে। প্রযুক্তিগত বিষয়গুলোতে সাহায্য নেওয়া যাবে। আমাদের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তখন আরও নিবিড়ভাবে তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পাবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত