বাঙালির কাঁধে কেবল শত শত বছরের উপনিবেশের জোয়ালই চেপে বসেনি কপালেও জুটেছে অপমানজনক বহু তকমা। প্রতারণা আর ঠগবাজি করে যে ইংরেজরা বাংলায় উপনিবেশ গড়েছিল সে ইংরেজই বাঙালিকে বলেছিল প্রতারক। ইংরেজ শাসনের জোয়াল নামাতে দু’শো বছর লেগে গেলেও বাঙালিরা প্রবঞ্চক ব্রিটিশের কথা ভোলেনি আজও। কি গ্রামে কি শহরে, কূটকৌশল করা লোক বোঝাতে আমজনতা এখনও ‘ব্রিটিশ’-ই বলে। দেখে নেওয়া যাক এই বাংলায় ইংরেজদের ব্রিটিশগিরির শুরুর কালটা কেমন ছিল। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।
পুরাতনী টেটন ঘোল খেয়েছে আধুনিক চিটারের সুক্ষ্ম টেকনিকে!
যে প্রতারণার এত দোষ এই বাংলায় তার চলতি শব্দগুলো তো দেখি আদি বাংলা নয় একটাও। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, তঞ্চকতা, শঠতা, মায় ছলনাও নির্ভেজাল সংস্কৃত। ঠগবাজি, বাটপারি হয়েছে সংস্কৃত থেকে। জোচ্চুরি, ধাপ্পাবাজি, ধোঁকাবাজি হয়েছে হিন্দি থেকে। বাঙালি আরেক ধোঁকা খায় পশ্চিমবঙ্গে ডাল দিয়ে রেঁধে! শঠ, প্রতারক, প্রবঞ্চক, ঠগবাজ, বাটপার, ধোঁকাবাজ, জোচ্চর কিছু ছিল বাংলায় টেটন নামে (বচনে আর নেই, আছে শুধু অভিধানে)। চিট [Cheat] বানিয়েছে ইংরেজ-ব্রিটিশে।
যে ইংরেজদের আমরা ‘ব্রিটিশ’ হিসেবে চিনি তাদের ব্রিটিশ পরিচয় এলো কোথা থেকে? ইংল্যান্ড পার্লামেন্টের ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দের আর স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টের ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দের বানানো আলাদা দুটি আইনের জোরে ‘কিংডম অব ইংল্যান্ড’ আর ‘কিংডম অব স্কটল্যান্ড’ মিলে ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে হয়ে যায় ‘কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন’; ওয়েলসকে ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইংল্যান্ডভুক্ত করে সারে ইংল্যান্ডের রাজারা। এসব অঞ্চল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে পরিচিত ছিল আরও আগে থেকে, যখন ৪৩-৪১০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ‘রোমান প্রভিন্স অব ব্রিটেন’। ‘ব্রিটেন’ নামটা আসে সেই থেকে। রবার্ট ক্লাইভরা এ ভারতভূমিতে আসে খাঁটি ব্রিটিশ হয়ে।
বাঙালিকে শঠ, প্রতারক বলে মেকলে সাহেব ঢালাও অপবাদটা ঢেলেছেন এক বাঙালি ব্রাহ্মণ মহারাজা নন্দ কুমারকে উপলক্ষ করে। [থমাস বেবিংটন মেকলে, এদেশে ইংরেজি প্রচলনের আসল কারিগর ও আমাদের ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দণ্ডবিধির মুসাবিদাকারী হিসেবে পরিচিত বেশি, ছিলেন ১৮৩৪-১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতায় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের ফার্স্ট ল কাউন্সেলর]
নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমল থেকে জগৎ শেঠ [মুঘল সম্রাটদের কাছ থেকে পাওয়া বংশানুক্রমিক উপাধি, টাকার কারবারি, সেকালের ব্যাংকার; আসল নাম মহাতপ চাঁদ], উমিচাঁদ [আগ্রা থেকে আসা; আফিম ও পটাসিয়াম নাইট্রেট (শোরা) কারবারি], মীর জাফরদের (মীর জাফর নিজে ছিলেন পারসি সৈয়দবংশজাত শিয়া মুসলমান; তার পিতামহ সৈয়দ হুসেন তাবাতাবাই ইরাকের নাজাফ থেকে দিল্লী আসেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমন্ত্রণে, কাজী হিসেবে কাজ করেন মোঘল দরবারে; কাজীর নাতি পাজি হয় শেষে!)] কাঁধে সওয়ার হয়ে ব্রিটিশরা বাংলায় যতগুলো ‘চিটারি’ আর কসাইগিরি করেছে (এগুলোকে রেভ্যুলিউশন বলেছেন মেকলে সাহেব; প্রতিবিপ্লবকে বিপ্লব বলে প্রতারকে!) তার সবগুলোতে অবাঙালি প্রবঞ্চকদের সাথে বাঙালি টেটন ছিল এক রায় দুর্লভ [নবাবের এক সেনাপতি] আর এক রাজবল্লভ [ঢাকার দেওয়ান, যার পুত্র কৃষ্ণদাস নবাবের কোশাগারের অর্থ আত্মসাৎ করে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় কোলকাতায় ব্রিটিশদের কাছে, তাকে ফেরৎ দিতে অস্বীকৃতি জানানোতেই নবাবে আর ব্রিটিশে যুদ্ধের সুত্রপাত ঘটে], আর ছিল রাঢ়বঙ্গ বীরভূমের ব্রাহ্মণ সন্তান এই নন্দ কুমার [তখন তিনি নবাবের অধীনে মোটে হুগলির ফৌজদার-শাসক]।
কাজ ফুরালেই পাজি বানিয়ে ব্রিটিশ একে একে সবাইকে খেয়েছে আগে, অতি চালাকের [নন্দ কুমারের] গলায় দড়ি দিয়েছে পরে! [মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ফাঁসিতে লটকায় ১৭৭৫-এর ৫ আগস্ট] বাটপারের ওপর চিটারি বলে একে! পুরাতনী টেটন ঘোল খেয়েছে আধুনিক চিটারের সুক্ষ্ম টেকনিকে!
চিটার সর্দার রবার্ট ক্লাইভ নাকি তার একান্ত বিশস্ত অনুচর নন্দ কুমারকে ‘ব্ল্যক কর্নেল’ ডাকতেন নিজে, আর মহারাজা উপাধিটা তিনি পাইয়ে দেন ১৭৬৫-তে দ্বিতীয় মেয়াদে গভর্নরগিরিতে এসে মোগল সম্রাট ২য় শাহ আলমের কাছ থেকে। তার আগে তিনি ১৭৫৮-১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম দফার গভর্নরগিরিকালে নন্দ কুমারকে বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলির দেওয়ান করে যান ওয়ারেন হেস্টিংসকে সরিয়ে। নন্দ কুমার ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তখন যে, এই হেস্টিংসই পরে শোধ নেবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর হয়ে ফিরে এসে গভর্নর-জেনারেলে উন্নীত হয়ে।
চিটার সর্দার রবার্ট ক্লাইভের নাকি প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রথমবার ভারত আসেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ১৯ বছর বয়সে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোমস্তাগিরির চাকরি নিয়ে ১৭৪৪-এর জুনে, পদস্থ হয়ে ছিলেন ভারতে ব্রিটিশের প্রথম ফোর্ট ‘ফোর্ট সেন্ট জর্জ’-এর মাদ্রাজ [এখনকার তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই] প্রেসিডেন্সিতে। ১৭৪৬-এর সেপ্টেম্বরে আক্রমণ করে ফরাসিরা ফোর্টের দখল নিয়ে ব্রিটিশদের বন্দি করে নিয়ে গিয়ে রাখে পন্ডিচেরিতে। সেখান থেকে ফন্দি করে ‘ফোর্ট সেন্ট ডেভিড’ [তামিলনাড়ুর কুদ্দালোরে] পালিয়ে এসেই ক্লাইভ গোমস্তাগিরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় পদাবনত হয়ে সৈনিক হিসেবে নাম লেখান কোম্পানির বাহিনীতে। ১৭৪৭-এর মার্চে ফরাসিরা এই ফোর্ট আক্রমণ করতে এলে ক্লাইভ তাদের মেরে খেদিয়ে উঠে যান জুনিয়ার অফিসার র্যাংক-এ। তারপরে ভারতেই একের পর এক যুদ্ধে খেল দেখিয়ে উঠতে থাকেন র্যাংকে। এসব রণখেলায় তার নৈপুণ্য দেখে তাক লেগে তাকে স্বর্গজাত জেনারেল [Heaven-Born General] বলেছিলেন খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দ্য এল্ডার। কোম্পানির চাকরি ছেড়ে জাতীয় বীর বেশে ক্লাইভ দেশে ফিরে যান ১৭৫৩-এর ফেব্রুয়ারিতে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বছরখানেকের এমপিগিরি খুইয়ে ক্লাইভ লেফ্টেন্যান্ট-কর্ণেল র্যাংক নিয়ে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে কোম্পানির চাকরি ধরে ১৭৫৫-র জুলাইতে দ্বিতীয়দফা ভারত এসে পদস্থ হন কোম্পানির মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনস্থ ‘ফোর্ট সেন্ট ডেভিড’-এ। ওদিকে, বাংলায় তখন নবাবের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশিমবাজার কুঠি আর কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামের শ্রীবৃদ্ধির নামে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকায় এবং নবাবের কোশাগারের অর্থ আত্মসাৎ করে নিয়ে কোলকাতায় আশ্রয় নেওয়া কৃষ্ণ দাসকে ফেরৎ দিতে অস্বীকার করায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬-এর জুনে সে-দুটি আক্রমণ করলে ‘ফোর্ট সেন্ট জর্জ’-এর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কাছে সাহায্য চেয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেসিডেন্ট-গভর্নর রজার ড্রেক ও কাশিমবাজারের কুঠিয়াল উইলিয়াম ওয়াটস পালিয়ে যান বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার ডায়মন্ড হারবার মহকুমাধীনে গঙ্গা ও হুগলি নদীর তীরবর্তী ফলতা গ্রামে।
মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির নির্দেশে ১৭৫৬-এর ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ‘রয়্যাল নেভি’-র অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসনের সঙ্গে হুগলি নদী দিয়ে এসে ক্লাইভ কুঠি ও ফোর্টের উদ্ধারকাজ সেরে নবাবের দরবারে মীর জাফরদের অসন্তোষ আর বিরোধের গোপন খবর পেয়ে বাংলা দখলের বুদ্ধিটা চট করে পাকিয়ে ফেলেন নিজে থেকে। মীর জাফরদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি অলিখিত বুদ্ধির পুরো চক্রান্তটা নিজ হাতে পাকিয়ে ১৭৫৭-র ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে যুদ্ধের প্রতারণা সেরে মীর জাফরকে শিখণ্ডী নবাব বানিয়ে সিরাজউদ্দৌলা উৎখাতনাটের গুরু ক্লাইভ নিজে বসেন কোম্পানির বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (কেতাবি নাম: Presidency of the Fort William in Bengal) গভর্নর হয়ে।
(চলবে)
লেখক: প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: [email protected]