Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

বাঙালিকে প্রতারক বলা ইংরেজের ব্রিটিশগিরি-২

শিল্পীর তুলিতে বক্সারের যুদ্ধ, ২২ অক্টোবর ১৭৬৪। চিত্রকর্ম সূত্র: সিভিল আসপাইরেন্ট ডট ইন।

বাঙালির কাঁধে কেবল শত শত বছরের উপনিবেশের জোয়ালই চেপে বসেনি কপালেও জুটেছে অপমানজনক বহু তকমা। প্রতারণা আর ঠগবাজি করে যে ইংরেজরা বাংলায় উপনিবেশ গড়েছিল সে ইংরেজই বাঙালিকে বলেছিল প্রতারক। ইংরেজ শাসনের জোয়াল নামাতে দু’শো বছর লেগে গেলেও বাঙালিরা প্রবঞ্চক ব্রিটিশের কথা ভোলেনি আজও। কি গ্রামে কি শহরে, কূটকৌশল করা লোক বোঝাতে আমজনতা এখনও ‘ব্রিটিশ’-ই বলে। দেখে নেওয়া যাক এই বাংলায় ইংরেজদের ব্রিটিশগিরির শুরুর কালটা কেমন ছিল। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।   

(প্রথম পর্বের পর)

১৭৬৫-এর মে-তে রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয় মেয়াদে গভর্নরগিরিতে আসেন। আগেরবারে ৩৫ বছর বয়সী ক্লাইভ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গভর্নরগিরিতে ইস্তফা দিয়ে ব্রিটেন ফিরে যান ১৭৬০-এর জানুয়ারিতে, নগদ অর্থকড়ির সঙ্গে নাকি ১৭৫৩-এর ফেব্রুয়ারিতে মাদ্রাজের সেন্ট মেরিজ চার্চে বিয়ে করা বউ মার্গারেট মাসকেলাইনকে নিয়ে! ক্লাইভের স্বাস্থ্য আসলেই খুব একটা সুস্থ ছিল না। ১৭৫০-এ একবার স্নায়বিক জটিলতায় আক্রান্ত হলে আরোগ্য লাভের জন্য তাকে বাংলার উত্তরে পাঠানো হয়। সেখানে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে কোম্পানির এক জুনিয়র অফিসার আরেক রবার্টের সঙ্গে, পুরো নাম যার রবার্ট ওরমে, যিনি পরবর্তীকালে ভারতবেত্তা হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাত হন।

ক্লাইভ সুস্থ হয়ে মাদ্রাজে ফেরেন ১৭৫১-তে। কোম্পানি সেই রবার্ট ওরমেকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির গভর্নরের কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত করে ১৭৫৪-তে। ১৭৫৬-তে নবাব সিরাউদ্দৌলার বিরুদ্ধে অভিযানে মাদ্রাজ থেকে ৩১ বছর বয়সি রবার্ট ক্লাইভকে ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়কত্ব দিয়ে পাঠানোতে এই রবার্ট ওরমের নাকি বিশেষ হাত ছিল। রবার্ট ক্লাইভ মারা যান মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, ১৭৭৪-এর নভেম্বরে, এ-মৃত্যুর পেছনেও তার স্নায়বিক জটিলতা অনেকখানি দায়ী।

শিল্পী নাথানিয়েল ডান্সের তুলিতে রবার্ট ক্লাইভ। চিত্রকর্ম সূত্র: উইকিমিডিয়া ডট ওআরজি।

১৭৬০-এ ক্লাইভ যখন ব্রিটেন ফিরে যান তখন তিনি মেজর জেনারেল। ১৭৬৫-তে ক্লাইভ আসেন দ্বিগুণ ক্ষমতা নিয়ে গভর্নর ও কমান্ডার-ইন-চিফ হয়ে।

ক্লাইভ ফিরে এসে বাংলার শিখণ্ডী নবাবের গদিতে পান এক নাবালককে। ১৭৬৫-এর ফেব্রুয়ারিতে মীর জাফর মারা যায়, আর তার আগেই তার একমাত্র সাবালক পুত্র মীর মীরন [নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার নির্দেশদাতা] ১৭৬০-এর জুলাইয়ে বিহারের যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁবুতে বজ্রপাতে পুড়ে মরে। মীর জাফর ও তার বাঁদী থেকে বেগম মুন্নি বাঈ ওরফে মুন্নি বেগম দম্পতির ১৫ বছর বয়সী পুত্র নাজিমউদ্দিন আলি খান ওরফে নাজিমউদ্দৌলাকে শরীকদের ক্যাচাল ছুটিয়ে গদিতে বসায় ব্রিটিশরাই।

ক্লাইভ নাবালক নাজিমউদ্দৌলাকে আগলাতে ‘সুবে বাংলার নায়েব-নাজিম’ নামে নতুন পদ বানিয়ে বসান ঢাকার ‘নায়েব-নাজিম’ বিশ্বস্ত রেজা খানকে মুর্শিদাবাদে উঠিয়ে এনে। এই ‘নায়েব-নাজিম’ হলো নবাবীর অধীনস্থ উপ-প্রশাসক। নবাবরা ছিলেন ‘নবাব-নাজিম’: একই অঙ্গে দেওয়ান ও সুবেদার। মোগলের সুবে বাংলার দেওয়ান মুরশিদ কুলি খান ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ফররুখশিয়ারের কাছ থেকে একইসঙ্গে সুবেদার [প্রশাসক] নিয়োগ পেয়ে হন প্রথম নবাব-নাজিম।

১৭৬৪-এর বক্সার যুদ্ধের পরাজয়ে কাহিল ঠুঁটো মোগল সম্রাট ২য় শাহ আলমের নাকে বছরে ২৬ লাখ রুপি সেলামির মূলো ঝুলিয়ে [১৭৬৫-এর ১২ আগস্টের এলাহাবাদ চুক্তিতে] শাহী ফরমান হাতিয়ে শিখণ্ডী নবাবের নিজামতি [দেওয়ানি বাদে বাকি প্রশাসন] চালাবার খরচা হিসেবে বছরে ৫৩ লাখ রুপি দেওয়ার কথা দিয়ে [১৭৬৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের চুক্তিতে] ১৭৬৫-তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার (উড়িষ্যাটা শুধু নামেই, বেশির ভাগটাই তখন মারাঠাদের কবলে চলে যায় ১৭৫১-তে আলীবর্দী খাঁর আমলে) দেওয়ানি বাগিয়ে নেবার পরে কোম্পানির দেওয়ানি সামলাতেও সেই রেজা খানকেই বসান আরেক নতুন পদ ‘কোম্পানির নায়েব-দেওয়ান’ বানিয়ে।

ক্লাইভ বাংলার দু-দুটো নায়েবি দিয়ে যান এক পারসিবংশোদ্ভূত শিয়া-মুসলমান রেজা খানকে। আর, বাঙালি ব্রাহ্মণ নন্দ কুমারকে দেওয়ানগিরির ওপরে আর উঠিয়ে আনার ভরসাই নাকি পাননি! সেই নায়েবি দুটো পাবার আশে নন্দ কুমার লাগেন রেজা খানের পিছে। কোম্পানির কান ভারী করতে থাকেন রেজা খানের দুর্নীতির অভিযোগ ঢেলে ঢেলে।

হেস্টিংস শত্রুতা মনে পুষে নন্দ কুমারের খাটনি থেকে রেজা খানের নায়েবি দুটো একেবারে ঘুঁচিয়ে (পদ দুটোই দেন উঠিয়ে) আর শিখণ্ডীদের নবাবীও ছুটিয়ে (ক্ষমতাহীন মাসোহারাভোগী বানিয়ে নামকাওয়াস্তে রেখে) সরাসরি কোম্পানি শাসন বসাবার পুরো ফায়দা তুলে নেন। ওয়ারেন হেস্টিংস তার ১৭৭২-এর ‘Judicial Plan’-এর অধীনে ২১ আগস্ট থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন চালু করেন।

১৭৭২-এর এপ্রিলে নতুন গভর্নর হয়ে এসেই ওয়ারেন হেস্টিংস (তিনিই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শেষ গভর্নর) রেজা খানকে জেলে পুরে ইনকোয়ারি লাগান কোম্পানির ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর [বোর্ড অব ডিরেক্টর্স বলে যাকে এদেশে] কথাতে। সেই ইনকোয়ারিতে অভিযোক্তা হিসেবে প্রকাশ্যেই খাড়ান নন্দ কুমার পুরাতন শত্রু হেস্টিংসের দরবারে। ততদিনে হেস্টিংস সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত (ফৌজদারি) আদালতের ভার নিয়ে নিয়েছেন নিজে। ‘Hastings Judicial Plan of 1772’-এর আওতায় ‘গভর্নর এন্ড কাউন্সিল’-এর অধীনে কোলকাতায় বসানো হয় বাংলার সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত [ফৌজদারি] আদালত।

হেস্টিংস শত্রুতা মনে পুষে নন্দ কুমারের খাটনি থেকে রেজা খানের নায়েবি দুটো একেবারে ঘুঁচিয়ে (পদ দুটোই দেন উঠিয়ে) আর শিখণ্ডীদের নবাবীও ছুটিয়ে (ক্ষমতাহীন মাসোহারাভোগী বানিয়ে নামকাওয়াস্তে রেখে) সরাসরি কোম্পানি শাসন বসাবার পুরো ফায়দা তুলে নেন। হেস্টিংস তার ১৭৭২-এর ‘Judicial Plan’-এর অধীনে ২১ আগস্ট থেকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সরাসরি কোম্পানি শাসন চালু করেন। কোর্ট অব ডিরেক্টর্সের নির্দেশে ১৭৭২-এর এপ্রিলে কাউন্সিলের চার সদস্য নিয়ে ‘Committee of Circuit’ বানিয়ে কাজে নেমে চার মাসেই কাজ সেরে ১৫ আগস্টে ‘Governor and Council’-এ সেই প্ল্যান পেশ করে পাস করান।

বাঙালিকে প্রতারক বলা ইংরেজের ব্রিটিশগিরি-১

শিখণ্ডীর আসনে তখন মীর জাফরের আরেক নাবালক পুত্র মুবারকউদ্দৌলা [ওরফে মুবারক আলি খান, ১২ বছর বয়সে নবাব হন ১৭৭০-এ]। তার গর্ভধারিণী মাতা বাব্বু বেগমকে থুয়ে বিমাতা মুন্নি বেগমকে তার অভিভাবক করে হারেমপ্রধান আর নন্দ কুমারের পুত্র গৌর দাসকে হারেমপ্রধানের সহকারী বানান হেস্টিংস। তারপরে নিজ দরবারে প্রলম্বিত বিচারে রেজা খানকে খালাস দেন ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পার করে (এর চেয়ে ঢের বেশি বিলম্ব ঘটে আমাদের একালের দ্রুত বিচার আদালত/ট্রাইব্যুনালেও)। 

শিল্পী থমাস লরেন্সের তুলিতে ওয়ারেন হেস্টিংস। চিত্রকর্ম সূত্র: উইকিমিডিয়া ডট ওআরজি।

১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ‘রেগুলেটিং অ্যাক্ট’-এ হেস্টিংসকে গভর্নর-জেনারেলে উন্নীত করে (মাদ্রাজ ও বোম্বে প্রেসিডেন্সিকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির তদারকির অধীনে এনে হেস্টিংসকেই প্রথম গভর্নর-জেনারেল নিয়োগ দেওয়া হয় এ-অ্যাক্টে) তাকে সামলাতে ৪ জন কাউন্সেলরও [Counsellor] জুড়ে দেওয়া হয় সঙ্গে। গভর্নর-জেনারেল আর তার চার কাউন্সেলর মিলে ‘গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিল’ (সুপ্রিম কাউন্সিলও বলা হতো একে)-এর হাতে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শাসনভার। ‘ভেটো-পাওয়ার’ ছিল না গভর্নর-জেনারেলের, ছিল মোটে বাড়তি একখানা ভোট, যদি দুই মতে সমান সমান ভোট হয়ে যায় কখনও কোনও কাউন্সেলরের অনুপস্থিতির কারণে। কাউন্সেলররা ব্রিটেন থেকে কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামে এসে পৌঁছান ১৭৭৪-এর অক্টোবরের শেষ নাগাদ, তারপরে এই কাউন্সিলের কাজ শুরু হয়।

কাউন্সেলরদের তিন জনই ছিলেন হেস্টিংসবিরোধী। ব্রিটেন থেকে তারা এসে পৌঁছান ১৭৭৪-এর অক্টোবর প্রায় পার করে। তাদের দেখে নন্দ কুমার মহানন্দে লাগেন এবার ১৭ বছরের পুরাতন শত্রু হেস্টিংসের পিছে। রেজা খানের খালাসে, নিজ পুত্র গৌর দাসের আর মুন্নি বেগমের নিয়োগে হেস্টিংসের লাখ লাখ রুপি ঘুষ নেওয়া ছাড়াও আরও সব কর্মকাণ্ডে হেস্টিংসের ঘুস-দুর্নীতি আর জালিয়াতি কারবারের খবর পাতা ভরে ভরে দেন কাউন্সেলরদের।

নিজ পুত্রের নিয়োগে ১ লাখ রুপি ঘুষদাতা সাক্ষী নন্দ কুমার নিজে। কাউন্সিলের শুনানিতে অভিযোক্তা ও সাক্ষী রূপে নিজেই খাড়ান তিনি, আর মুন্নি বেগমের কাছ থেকে ২.৫ লাখ রুপি ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ হিসেবে খাড়া করেন মুন্নি বেগমের সিলছাপ্পর মারা বলে একখানা পত্র। সেখানা জাল বলে হেস্টিংস আপত্তি তুললেও পাত্তা পায়নি সংখ্যগরিষ্ঠতার কাছে। (নন্দ কুমারের তড়িঘড়ি ফাঁসিটা কিন্তু হয়েছিল অন্য একটা জালিয়াতি মামলায় কোলকাতা ‘সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিক্যাচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম’-এর বিতর্কিত বিচারে, সে-বৃত্তান্তে আসছি একটুখানি পরেই) বেগতিক দেখে শুনানি বন্ধ বলে উঠে চলে যান হেস্টিংস, পিছে পিছে যান তার সহমতী কাউন্সেলর বারওয়েল। কাউন্সেলর ক্লেভারিংকে সভাপতির আসনে বসিয়ে বাকি দুই কাউন্সেলর ফিলিপ ফ্রান্সিস ও মনসন মিলে শুনানি চালিয়ে গিয়ে শেষে সাব্যস্ত করেন: হেস্টিংস দুর্নীতি করে কামিয়ে ফেলেছে ৩০-৪০ হাজার পাউন্ড, সবটাই তার এখন ফেরত দিতে হবে কোম্পানির কোশাগারে। বিজয়ী নন্দ কুমার নাকি সম্বর্ধিত হতে হতে কাচারি খুলে বসেন নিজ দেওয়ানিতে, হেস্টিংসের আরও সব আকাম-কুকামের অভিযোগ অন্য সবার দাখিলে! ব্রিটিশের শাসন-নীতির মারপ্যাঁচটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি তখন ভেতো বাঙালি নন্দ কুমার!

১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেই পড়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের খপ্পরে।

(চলবে)

লেখক: প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: moyeedislam@yahoo.com

মঈদুল ইসলাম। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত