বাঙালির কাঁধে কেবল শত শত বছরের উপনিবেশের জোয়ালই চেপে বসেনি কপালেও জুটেছে অপমানজনক বহু তকমা। প্রতারণা আর ঠগবাজি করে যে ইংরেজরা বাংলায় উপনিবেশ গড়েছিল সে ইংরেজই বাঙালিকে বলেছিল প্রতারক। ইংরেজ শাসনের জোয়াল নামাতে দু’শো বছর লেগে গেলেও বাঙালিরা প্রবঞ্চক ব্রিটিশের কথা ভোলেনি আজও। কি গ্রামে কি শহরে, কূটকৌশল করা লোক বোঝাতে আমজনতা এখনও ‘ব্রিটিশ’-ই বলে। দেখে নেওয়া যাক এই বাংলায় ইংরেজদের ব্রিটিশগিরির শুরুর কালটা কেমন ছিল। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।
(দ্বিতীয় কিস্তির পর)
১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেই পড়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের খপ্পরে। এই কোম্পানি গঠনের শুরুটা হয়েছিল আরো পৌনে শতাব্দী আগে। রানী ১ম এলিজাবেথের আমলের শেষভাগে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ক্ষমতাসীন গুটিকয় রাজনীতিকের (যার এক নম্বরেই ছিলেন খোদ রানীর জ্ঞাতিভাই ‘আর্ল অব কামবারল্যান্ড’ জর্জ) সঙ্গে উঠতি অভিজাত ধনিক-বণিকেরা মিলে মোট ২১৯ জন শেয়ারহোল্ডারে রানীর চার্টার বাগিয়ে ‘Governor and Company of Merchants of London Trading into the East-Indies’ নামে জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি গড়ে তোলেন। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে সে-কোম্পানি আরেক কোম্পানির (১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সৃষ্ট ‘English Company Trading to the East-Indies’) সঙ্গে একীভূত হয়ে ‘United Company of Merchants of England Trading to the East-Indies’ হয়।
অবশ্য তারও আগে তো রাজারাই পড়েছিল পার্লামেন্টের খপ্পরে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের পূর্বসূরি ‘ম্যাগনাম কনসিলিয়াম’-এর ‘ব্যারোন’-রা (বিশাল বিশাল জমিদারির অধিকারী অভিজাতরা; পার্লামেন্টও অভিজাতদেরই দখলে সর্বকালে, গণতন্ত্রের ভোটভেলকিতে কমজাতরা কেউ কখনো জিতে গেলে তারাও উঠে যায় অভিজাতে, ভেলকিটা হোক রাতের অন্ধকারে কি দিনের আলোতেই, কমজাত কি অভিজাতই হোক, উঠে এসে শেষে হয় বজ্জাত!) রাজার একনায়কত্বে লাগাম দেয়া শুরু করে সেই মধ্যযুগের মধ্যভাগে ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দের ‘ম্যাগনা কার্টা’ (Latin word ‘Magna Carta’, meaning: ‘Great Charter’) দিয়ে। তারা সেই রাজাকেই বাঁধে রাজার চার্টারে! রাজাকে চলতে হবে অভিজাতদের সঙ্গে আঁতাত করে!
যুগে যুগে, দেশে দেশে, সব শাসকই চলে এই আঁতাত করে; কৈশোরোত্তীর্ণ ২২ বছরের উদ্দাম যুবক সিরাজউদ্দৌলা উত্তাল আত্মবিশ্বাসের আতিশয্যে সেই আঁতাতকে অবজ্ঞা করে নবাবী খুইয়ে আত্মবলিদান দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন বাংলায়; ডিজিটালের স্মার্টযুগে শাসকেরা তাই ভুলেও আর ভুল করে না সেই আঁতাত রেখে চলতে!
ইংল্যান্ডে রাজদত্ত খেতাবধারী রাজভক্ত বিশাল বিশাল জমিদারির অধিকারী অভিজাত লর্ডরা আর কমিউনগুলোর প্রতিনিধিরা [এরাও একেকজন সামন্তপ্রভুই বটে, রাজাকে নিয়মিত খাজনা দেয়া ও যুদ্ধে বাহিনী নিয়ে রাজার সঙ্গে থাকার বিনিময়ে সামন্তগিরি চালাত] এককক্ষে একসঙ্গেই বসত পার্লামেন্টে। ১৩৪১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসে কমিউনগুলোর প্রতিনিধিরা রাজদত্ত খেতাবধারী রাজভক্ত লর্ডদের থেকে আলাদা বসা শুরু করে। এক-কক্ষীয় থেকে হয়ে যায় দ্বিক্ষীয়: লর্ডরা উচ্চকক্ষে, কমিউনগুলোর প্রতিনিধিরা নিম্নকক্ষে। ১৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দের দিক থেকে উচ্চকক্ষকে ‘হাউস অব লর্ডস’ আর নিম্নকক্ষকে ‘হাউস অব কমনস’ নাম দেয়া হয়।
ভারতে কোম্পানি যখন বসতে থাকে জাকিয়ে, ব্রিটিশের নিজ দেশে তখন পার্লামেন্টারিয়ানরা [পার্লামেন্টারিয়ান বলতে সাধারণভাবে ‘হাউস অব কমনস’-এর সদস্যদেরই বোঝায় সেখানে] বেড়ে উঠতে থাকে রাজার ওপর দিয়ে। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টারিয়ানরা ১৬৩৯-১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিন-তিনটা গৃহযুদ্ধের মহাবিদ্রোহ [Great Rebellion] আর ১৬৮৮-১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রায় রক্তপাতহীন মহা-অভ্যুত্থান [Great Revolution] ঘটিয়ে রাজা-রানীকে (এই রানী হলো রাজসিংহাসনে সমাসীন নারী; রাজার বউ রানী হলো ‘Queen Consort’) সংবিধান হিসেবে বিবেচিত সব ‘Act of Parliament’ [পার্লামেন্টে বিল পাসের মাধ্যমে প্রণীত আইন]-এর আওতায় এনে ‘King-in-Parliament’ বানিয়ে ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সূচনা করে এখনকার সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের। দিনে দিনে রাজার ক্ষমতা খর্ব করে সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে থাকে পার্লামেন্ট, সরকার চালাবার ‘পাওয়ার’ [ক্ষমতা] নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে চলে পার্লামেন্টারি শাসন।
বাড়াবাড়ি ঠান্ডা করতে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টই [House of Commons] ভেঙে দেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড পৃথক তিন রাজ্যের একচ্ছত্র রাজা ১ম চার্লস ১৬২৯-এর মার্চে, ১৬৪০ পর্যন্ত টানা ১১টা বছর পার্লামেন্ট ছাড়াই চালিয়ে যান একাই [ইতিহাসে যা তার ‘Personal Rule’ বলে পরিচিত]। রাজার একনায়কত্বে অতিষ্ঠ তিন রাজ্যেরই পার্লামেন্টারিয়ানরা, যুদ্ধ [Civil War] লাগায় রাজার বিরুদ্ধে।
তারা ১৬৩৯-১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিন-তিনটা গৃহযুদ্ধের মহাবিদ্রোহে [Great Rebellion] রাজা ১ম চার্লসকে ১৬৪২-এর আগস্টে রাজধানীছাড়া করে, ১৬৪৬-এর এপ্রিল থেকে বন্দি রেখে রাজসম্মতি [Royal Assent] ছাড়াই এবং হাউস অব লর্ডস-এর অসম্মতি উপেক্ষা করে নিজেরা নিজেরাই [Rump Parliament] আইন বানিয়ে রাজাকেই রাজদ্রোহে অভিযুক্ত করে, ‘High Court of Justice’ নামে নতুন কোর্ট বানিয়ে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ১৬৪৯-এর ৩০ জানুয়ারি কল্লা কেটে (শিরোশ্ছেদই ছিল সেকালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিয়ম) খতম করে রাজাকে।
নতুন কারো রাজা হওয়াও নিষিদ্ধ করে সেদিনই জরুরি আরেক আইন বানিয়ে। হাউস অব লর্ডস আর রাজতন্ত্র উৎখাত করে মার্চে আরও দুটি আইন বানিয়ে। রাজা আর হাউস অব লর্ডস ছাড়াই তারা নিজেরাই চালিয়ে যায় পরবর্তী ১১টি বছর [Interregnum]। নিজেরা নিজেরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে শেষে ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ১ম চার্লসেরই পুত্র ২য় চার্লসকে নেদারল্যান্সের নির্বাসন থেকে ডেকে এনে চুক্তিতে বেঁধে কাবু করে রাজাসনে বসিয়ে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা [Restoration] করে।
শেষ দিকে এসে রাজা ২য় চার্লস ১৬৭৯-এর জানুয়ারি থেকে ১৬৮১-র মার্চ পর্যন্ত চার-চারবার পার্লামেন্ট ভাঙেন আর গড়েন, তারপর পার্লামেন্ট ছাড়াই চালিয়ে যান একাই ১৬৮৫-এর ফেব্রুয়ারিতে তার মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। প্রথমটি বাদে বাকি তিনবার পার্লামেন্ট ভাঙার কারণ ছিল একই।
১৬৭৯-এর জুনে রাজা ২য় চার্লস পার্লামেন্ট ভাঙেন তার ক্যাথলিক বনে যাওয়া ভাই ২য় জেমসকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর [পরবর্তী রাজা হওয়ার] তালিকা থেকে বাদ দেবার বিল আটকাতে। এই বিল নিয়ে পার্লামেন্ট ভাগ হয়ে যায় দু-দলে: বিলের পক্ষীয়রা হলেন ‘Whigs’, বিপক্ষীয়রা [রাজপক্ষীয়] হলেন ‘Tories’; এভাবেই সেখানে জন্ম হয় দ্বিদলীয় রাজনীতি।
বাঙালিকে প্রতারক বলা ইংরেজের ব্রিটিশগিরি-২
বিভাজনের রাজনীতির চালে ২য় চার্লসের দিন পার হয়ে দ্বিতীয় জেমসের দিন শুরু হয়। লেগে যায় কিছুদিন পরেই। ১৬৮৫-র নভেম্বরেই পার্লামেন্ট ভেঙে দেন রাজা, আর ডাকেননি ১৬৮৮-র ডিসেম্বরে রাজসীলমোহর টেমস নদীতে ফেলে পালিয়ে যাবার দিন পর্যন্ত। তার আগে জুনেই পার্লামেন্টারিয়ানরা (কিছু টরিজও ছিল হুইগসদের সঙ্গে) ডাক দেয় জেমসেরই ভাগ্নে ও জামাতা নেদারল্যান্ডসের ‘Prince of Orange’ ৩য় উইলিয়ামকে সসৈন্যে আসতে। নভেম্বরে তিনি সদলবলে এসে পড়লে জেমসের বাকি লোকেরাও পক্ষ ত্যাগ করে ভিড়ে যায় ভাগ্নের দলে। (মামা ভেগেছিল কি আর সাধে!)
১৬৮৮-১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রায় রক্তপাতহীন এই মহা-অভ্যুত্থান [Great Revolution] ঘটিয়ে পার্লামেন্টারিয়ানরা রাজার শূন্য সিংহাসনে একসঙ্গে বসায় ‘Prince of Orange’ ৩য় উইলিয়াম ও তার স্ত্রী (২য় জেমসেরই কন্যা ২য় মেরি) দম্পত্তিকে। সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর তালিকায় [রানী ১ম এলিজাবেথের বাবা রাজা ৮ম হেনরির ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে করা ‘Succession to the Crown Act’/‘Third Succession Act’অনুসারে] ২য় জেমসের পরেই এক নম্বরে ছিলেন তার কন্যা এই ২য় মেরি, দু-নম্বরে ছিলেন মেরিরই আপন বোন অ্যানে [Anne], তিন নম্বরে ছিলেন মেরির স্বামী এই তৃতীয় উইলিয়াম।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এতদিন চলছিল রাজা/রানীর একান্তই বিশেষাধিকারবলে প্রদত্ত রাজসনদে [Royal Charter], লাগাম ছিল ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর হাতে। ১৭৬৫-তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি নেবার পরে বাংলায় প্রথম দুর্ভিক্ষ ঘটিয়েও নিজেদের কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতি আর অদক্ষতাতে ডুবতে বসে কোম্পানি। বাংলার একতৃতীয়াংশ লোক মারা যাওয়া ১৭৬৯-৭০ খ্রিষ্টাব্দের সেই দুর্ভিক্ষের বাংলা সন ছিল ১১৭৬, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে যা বাংলার ইতিহাসে, তার আগে আর এমনটা ঘটেনি বাংলাতে।
১৭৬৮ থেকে ছিল ব্রিটিশ সরকারের খাজনা খেলাপি, দায়দেনা বছরে চল্লিশ হাজার পাউন্ড, তার ওপরে ছিল ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ঋণ খেলাপি। কোম্পানি ১৭৭২-এ এসে ব্রিটিশ সরকারের ঋণ চেয়ে ধরা খায় পার্লামেন্টের কাছে। কমিটি বানিয়ে তত্ত্বতালাশ নিয়ে পার্লামেন্ট শেষে ‘Regulating Act 1773’ [ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন, কেতাবি নাম: East India Company Act 1772] বানিয়ে ধরিয়ে দেয় ঋণ মঞ্জুরের সঙ্গে। শুরু হয় পেছন থেকে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর লাগাম ধরে কোম্পানির ভারতের কারবারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাত দেয়া।
এই রেগুলেটিং অ্যাক্টে ২৪ সদস্যের কোর্ট অব ডিরেক্টর্স ভেঙে দিয়ে নতুনভাবে ৬ জনকে ১ বছর মেয়াদে, আরো ৬ জনকে ২ বছর মেয়াদে, তারপরের ৬ জনকে ৩ বছর মেয়াদে, আর বাকি ৬ জনকে ৪ বছর মেয়াদে ডিরেক্টর করে কোর্ট অব ডিরেক্টরস পুনর্গঠন করে দিয়ে পুনর্নির্বচিত হবার অযোগ্য করে, পরবর্তী বছর থেকে প্রতিবছর নতুন মুখের ৬ জন করে ডিরেক্টর ৪ বছর মেয়াদে নির্বাচনের নিয়ম করা হয়। ডিরেক্টরদের নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচিত হবার যোগ্যতাদিও রদবদল করা হয়।
এই অ্যাক্টে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর-জেনারেল আর তার চারজন কাউন্সেলর [Counsellor] নিয়োগ দেয়া হয়; The First Governor-General: Warren Hastings, Esquire; The First Four Counsellors: (i) Lieutenant-General John Clavering (Commander-in-Chief of British Army in India), (ii) George Monson, (iii) Richard Barwell and (iv) Philip Frances, Esquire; তাদের নিয়োগ ছিল ৫ বছরের জন্য এবং এ-সময়র মধ্যে কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর রিপ্রেজেন্টেশেনের প্রেক্ষিতে দেয়া রাজার আদেশে ছাড়া (রাজার কাছে যেতে হবে পার্লামেন্ট হয়েই) অপসারণ অযোগ্য।
কোম্পানির বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার আয় থেকে গভর্নর-জেনারেল-এর বেতন বছরে ২৫ হাজার পাউন্ড, আর কাউন্সেলরদের বেতন বছরে ১০ হাজার পাউন্ড করে নির্ধারণ করে, উৎকোচ-উপঢৌকন (ঘুষ) নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়।
(চলবে)
লেখক: প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: moyeedislam@yahoo.com