বাঙালির কাঁধে কেবল শত শত বছরের উপনিবেশের জোয়ালই চেপে বসেনি কপালেও জুটেছে অপমানজনক বহু তকমা। প্রতারণা আর ঠগবাজি করে যে ইংরেজরা বাংলায় উপনিবেশ গড়েছিল সে ইংরেজই বাঙালিকে বলেছিল প্রতারক। ইংরেজ শাসনের জোয়াল নামাতে দু’শো বছর লেগে গেলেও বাঙালিরা প্রবঞ্চক ব্রিটিশের কথা ভোলেনি আজও। কি গ্রামে কি শহরে, কূটকৌশল করা লোক বোঝাতে আমজনতা এখনও ‘ব্রিটিশ’-ই বলে। দেখে নেওয়া যাক এই বাংলায় ইংরেজদের ব্রিটিশগিরির শুরুর কালটা কেমন ছিল। পাঁচ পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন শেষ পর্ব।
(চতুর্থ পর্বের পর শেষ অংশ)
৫.
সেকালের এক টাকার কারবারি বুলাকি দাসের কাছে নাকি নন্দ কুমার টাকা ধার করে দেনা স্বীকারে একখানা একরারনামা দিয়েছিলেন ১৭৬৫-তে। বুলাকি দাস মরে গেলে পরে ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসে নন্দ নাকি সে-একরারনামার কথা বিলকুল ইনকার [অস্বীকার] করেন। এই সব কথা লাগিয়ে বুলাকি দাসের সূত্রে দাবিদার হয়ে মোহন প্রসাদ, ছয়-ছয়টা বছর বসে থেকে পার করে, অভিযোগটা ঠোকেন একেবারে ঠিক ১৭৭৫-এর ৬ মে-তে এসে!
এত দেরিতে কেন? কারণ, ১৭৭৪-এর ২২ অক্টোবরের আগে জন্মই হয়নি যে ‘সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিক্যাচার’-এর! আর, ১৭৭৫-এর জানুয়ারির আগে তো এই ক্যাচার কাজেই নামেনি! সুপ্রিম কাউন্সিলে নন্দের কাছে হেস্টিংস মারটা খেয়েছে তো আরো একটু পরে! বাঙালিতে বাঙালিতে এই প্রতারণা-জালিয়াতির বিচার কি এই জুডিক্যাচারে চলে? হুজুর বাহাদুর সাহেবেরা চালালেই চলে!
নেবে কিভাবে? তারও উপায় একটা বের করে ন্যায়বিচারের সাহেব বাহাদুরেরাই! বিচারপ্রার্থী মোহন প্রসাদকে বন্ড দিতে বলা হলো ‘সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিক্যাচার’-এ বিচার চেয়ে। দুই পক্ষের সম্মতির বন্ড দেবার ব্যাপার একটা ছিল মেয়র কোর্টে স্থানীয় অধিবাসীদের নিজেদের মধ্যেকার বিরোধের বিচারে। ব্যবস্থাটা হয়েছিল ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দের চার্টারের বদৌলতে। সে-চার্টারের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মেয়র কোর্টের অংশগুলো বাতিল হয়ে যায় ১৭৭৩-এর রেগুলেটিং অ্যাক্ট আর ১৭৭৪-এর নতুন চার্টারে। তাতেই মেয়র কোর্ট উঠে গিয়ে বেঙ্গলে জন্ম নেয় এই সুপ্রিম জুডিক্যাচার।
এক বাঙালির ওপর আরেক বাঙালির ঘটানো ফৌজদারি অপরাধের বিচার এই জুডিক্যাচারে করতে স্পষ্ট নিষেধ নেই এই অ্যাক্টে আর নতুন চার্টারে, তাই দেখে আর নিজের কাজ খুশিমতো চালাবার ইচ্ছামতো বিধিমালা [রুলস] নিজেই বানাবার ক্ষমতাটাও পেয়ে তাই জুডিক্যাচার নিজেই নিয়ম বানিয়ে হুকুম দেয় বন্ড দাখিলের! জাস্টিস [ন্যায়বিচার] করতে হবে যে জাস্টিসদের!
ফৌজদারি এসব মামলা বিচারে তখন ছিল বটে জেলা নিজামত আদালত, সদর নিজামত আদালত। সদর নিজামত আদালত কোলকাতা থেকে মুরশিদাবাদে ফেরত পাঠিয়ে হেসিংস তার অনুগহপ্রাপ্ত মিত্র ও নন্দের নিগ্রহপ্রাপ্ত শত্রু রেজা খানকে আবার নায়েব-নাজিম বানিয়ে বসিয়েও ছিলেন। তবে সেটা নামকাওয়াস্তে! তদারকি-তত্ত্বাবধানের নামে কলকাঠি ছিল আবার গভর্নর-জেনারেল-ইন কাউন্সিলে। তার মানে আবার সেই কাউন্সেলর ফিলিপ ফ্রান্সিস, মনসন আর ক্লেভারিং-এর ত্রিমূর্তিচক্রের হাতে! শত্রুর শত্রু মিত্র রেজা খান থাকলেও তার ওপর ভরসা করলে ডুবতে হবে সখাত সলিলে! নন্দকে ছেড়ে ত্রিমূর্তিচক্রে ধরবে ঠেসে হেস্টিংসকেই! পুরাতন শত্রু নন্দকে তাই জন্মের মতো জব্দ করতে তোলে পুরাতন জিগরি দোস্তের নতুন সুপ্রিম জুডিক্যাচারে! বাঙালি হুকুমবরদার মোহন প্রসাদ পরদিনই হুকুম তামিল করে বন্ড দেয় ৭ মে। ইমপেকে আর পায় কে! পরদিনই শুরু হয়ে যায় বিচার ৮ মে থেকে। ব্রিটিশের হাতে সুপ্রিম কোর্টের শুরুটা কারচুপি দিয়ে!
বিচারটা হবে কোন আইনে? কোন আইনে আবার! ইংল্যান্ডের আইনে। ভারতবর্ষ, কি বাংলায় প্রতারণা-জালিয়াতি তখন গুরুতর অপরাধ ছিল না মোটে। সাজা ছিল মোটে কিছু টাকা জরিমানা বা কয়েক ঘা বেত্রদণ্ড, অথবা বড়োজোর অল্প ক’টা দিনের কারাদণ্ড (মেকলে সহেবের মুসাবিদা করা ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের আমাদের দণ্ডবিধিতে প্রতারণা-জালিয়াতির ৪২০ ও ৪৬৮ ধারায় সাজা সাত বছর, আর ৪৬৭ ধারায় বড়োজোর দশ বছর, খুব বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড)। ওসব ছুঁচো মারা সাজা নিজামত আদালতের কারবার! সুপ্রিম কোর্টের দরবারে কি সেসব মারা সাজে! ইংল্যান্ডে সব ধরনের প্রতারণা-জালিয়াতিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয় ১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দের আইনে। বাংলার প্রচলিত আইন রেখে দিয়ে গলায় দড়ি লাগিয়ে জন্মের সাজা দেওয়ার আনন্দে নন্দের বিচার ধরা হয় ইংল্যান্ডেরই সে-আইনে।
১৭২৯ খ্রিষ্টাব্দের আইনটা হয়েছিল তখনকার ইংল্যান্ডে প্রতারণা-জালিয়াতির জ্বালার চোটে (প্রতারণা-জালিয়াতি এতই বেড়ে গিয়েছিল, ঠিক যেন এখনকার আমাদের এখানকার মতো)! আয়ারল্যান্ড তখনো ব্রিটিশের সাথে আসার কথা ভাবেইনি (একীভূত হয়েছিল ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে), স্কটল্যান্ডে প্রযোজ্য হবে না বলে স্পষ্ট লেখাই ছিল আইনে। চিটারি করে বাংলা দখলের নাটের গুরু রবার্ট ক্লাইভ তখন মায়ের কোলে বছর দুয়েকের আঙুল চোষা শিশু (জন্ম তার ১৭২৫-এর নভেম্বরে)! আইনটা করা হয় শুধু ইংল্যান্ডের কথা মাথায় রেখেই। নন্দের বিচারের ঐ সময়টাতে গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশের কোম্পানির হয়ইনি, বাংলাটা শুধু গিলেছিল গোটাটাই। ততদিনে সে-আইন ইংল্যান্ডেই অচল, জারি হবে কি আর বাংলাতে!
নন্দ কুমার তো কোলকাতার বাসিন্দাও ছিলেন না, তার বিচার তবে কিভাবে হয় ইংল্যান্ডের সে-আইনে? এ যে সুপ্রিম কোর্ট! সব অসম্ভবই সম্ভব এখানে, সবই করতে পারে ক্ষমতাধরের খায়েশের টানটা টেনে! ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দের চার্টারে শুধু ব্রিটিশ নাগরিক-প্রজাদের ব্রিটিশ আইনে বিচারের যে এক্তিয়ার দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলে, ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দের চার্টারেও তা বহাল রাখা হয় গভর্নর ও কাউন্সিলে, তাতেই পেয়ে গেছে ১৭৭৪-এর অক্টোবরে প্রধানত কোলকাতার জন্য প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট, কোলকাতার বাসিন্দাদেরও ছাড়িয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ব্রিটিশ নাগরিক-প্রজাদেরও ছাড়িয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের বিচারেও এক্তিয়ার, বলে নিজে নিজেই ধরে নেয় নন্দের বিচারে!
বাঙালিকে প্রতারক বলা ইংরেজের ব্রিটিশগিরি-৪
নন্দের বিচার চুকেবুকে যাবার পরও ছলচাতুরির এই যুক্তি দিয়ে সুপ্রিমেসি চালাতে চালাতে সুপ্রিম কোর্ট বুমেরাং হয়ে ওঠে হেস্টিংসেরই নিজ কাজে! শেষে সুপ্রিম কোর্টের বুমেরাঙি ছুটাতে নামতে হয় হেস্টিংসকেই। মাত্র সাতটা বছরেই এদেশে স্বাধীন বিচারবিভাগের সখ মিটে যায় ব্রিটিশের। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে দিয়ে ‘বেঙ্গল জুডিক্যাচার অ্যাক্ট’ বানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আসল কেরদানি কেটেকুটে শুধু কোলকাতা নগরীতে বসবাসকারী ব্রিটিশ ও স্থানীয় অধিবাসীদের ওপরে আর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বসবাসকারী শুধু ব্রিটিশ প্রজাদের ওপরে এক্তিয়ার সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করে খোজা বানিয়ে ছাড়ে তাকে।
ষড়যন্ত্র মামলাটা আগে ঝটপট সেরে হিসাবমতো তাতে খালাস দিয়ে নন্দকে ধরে রাখে এই প্রতারণা-জালিয়াতিতে। ৭ জুন বিচার শুরুর পরে একটা দিনও দম [বিরতি] না নিয়ে পুরোদমে চালিয়ে ৮ দিনের খাটনিতেই বিচার শেষ। খাটনি কিন্তু, সত্যিই করেছিলেন জাস্টিস সাহেবেরা নন্দের সাফাই সাক্ষীদের নিজেরাই জেরা করে জেরবার করতে! বাদি, আসামি, সাক্ষীরা সবাই এদেশি। জাস্টিসেরা চার জনে আর জুরিরাও বারো জনেই ব্রিটিশ-ইংরেজ। বুঝাবুঝির কাম কী! ঠিক করাই আছে আগে থেকে! জাস্টিস সাহেবরা একবাক্যে দোষী সাব্যস্ত করেন নন্দকে, জুরিরাও সবে পোঁ ধরেন তাতে। ব্রাহ্মণ হত্যা মহাপাপ, সে হিন্দুশাস্ত্রে! বিটিশের বিচারে হিন্দু-মুসলমান সব সমান, পার্থক্য শুধু ব্রিটিশ-খ্রিষ্টানে! হিন্দু ব্রাহ্মণ নন্দ কুমারের ফাঁসির সাজা শুনিয়ে দেন চিফ জাস্টিস ইমপে। তড়িঘড়ি বিচার শেষ।
প্রিভি কাউন্সিলে যাবেন বলে দরখাস্ত দিলেন উকিল সাহেবরা। নামঞ্জুর সাথে সাথে ইমপের হাতে! ঝটপট ফাঁসির মঞ্চ বানানো হলো গঙ্গাজল প্রবাহিত হুগলি নদী (গঙ্গা নদীর স্রোতধারা যে সব নদী দিয়ে বয়ে যায় সেগুলোর মধ্যে হুগলি অন্যতম) তীরে কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে কুলি বাজারে (ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণকাজের শ্রমিকদের জন্য এ-এলাকা গড়ে ওঠে সেকালে)। প্রকাশ্যে ফাঁসিতে লটকানো হয় সেখানেই নন্দ মহারাজকে ১৭৭৫-এর ৫ আগস্ট সকাল আটটায়। ব্রাহ্মণহত্যার এ-পাপদৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অঝোরে অশ্রুপাত শেষে গঙ্গাস্নানে পবিত্র হয়ে নীরবে ঘরে ফিরে যায় শোকে মুহ্যমান ভেতো বাঙালির দল। শুধু ঢাকায় নাকি শোকোচ্ছ্বাস আর আতঙ্কের প্রকাশ হয়েছিল একটুখানি জোরেশোরে! ̶ বলেছেন সাহেব মেকলে।
সুপ্রিম কাউন্সিলের হেস্টিংসবিরোধী কাউন্সেলররা কিছুই করতে পারেননি নন্দ কুমারের জন্যে। আপিলের সুযোগ না দিয়ে, ব্রিটিশরাজের এমনকি বাংলার শিখণ্ডী নবাবের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে নন্দ কুমারের গলায় দড়ি দিয়ে লটকানো সারা হয় সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিক্যারের এক বিচারেই। ‘First Judicial Killing’ বলে কুখ্যাত হয়ে আছে যা বাংলার বিচারের ইতিহাসে। বাংলায় ব্রিটিশের প্রথম গভর্নর জেনারেল একা হেস্টিংসের খায়েসই পূরণ হয় ব্রিটিশের বানানো প্রথম স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট অব জুডিক্যাচারে।
বাংলায় নিজ নিজ অপকর্মের [Misconduct] দায়ে ১৭৮৭-তে হেস্টিংস আর ইমপে দুজনে একসঙ্গে পড়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিচারের মুখে। হাউস অব কমনসে Impeached [অভিশংসিত] হয়েও তাঁরা রক্ষা পান হাউস অব লর্ডসে। আধুনিক ব্রিটিশের এসব সূক্ষ্ম টেকনিকে ঘোল খেয়ে ধরা খায় পুরাতনী বাঙালি টেটনে।
(সমাপ্ত)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: [email protected]