বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে, তা নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।
দ্য মিনিস্টার’স মিলিয়নস শিরোনামে গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ওঠে আলোচনার ঝড়। বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী কীভাবে তিনটি দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেন, তা নিয়ে ওঠে প্রশ্ন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি আপসানা বেগম। তিনি এক চিঠিতে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন করেছেন তারই দেশের জাতীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সির (এনসিএ) কাছে।
যুক্তরাজ্যের পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজ আসন থেকে টানা দুবারের এমপি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই রাজনীতিক এনসিএর মহাপরিচালক গ্রেয়েম বিগারের কাছে লেখা চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ বাংলাদেশের বিগত সরকারে থাকা লোকজন সম্ভবত দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, এ নিয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এনসিএ।
এসব সম্পদ জব্দ করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন আপসানা বেগম। সে কথাও তিনি জানিয়েছেন এনসিএকে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা থেকে চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ছেলে। বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি তার।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে উপনির্বাচনে চট্টগ্রাম-১২ আসন থেকে নির্বাচিত হন সাইফুজ্জামান।
২০১৪ সালে চট্টগ্রাম-১৩ আসন থেকে আবার নির্বাচিত হন তিনি। সেবার তাকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৩ আসন থেকে ফের নির্বাচিত হন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়ী হন সাইফুজ্জামান।
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেকের মতো সাইফুজ্জামান চৌধুরীও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপরই বিভিন্ন দেশে থাকা তার সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধানে নামে আল জাজিরা।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কেবল যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা।
এসব বাড়ির বর্তমান বাজারদর ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তার সম্পদ রয়েছে।
সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পদ সম্পর্কে ব্রিটিশ এমপি আপসানা বেগম চিঠিতে বলেন, “বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও যুক্তরাজ্যে কোটি কোটি ডলার পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন।
“যুক্তরাজ্যের আবাসন, সম্প্রদায় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ও ব্রিটিশ সরকারের নির্বাহী সংস্থা কোম্পানিজ হাউজের রেকর্ড পর্যালোচনা করেছে দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ২৮০টি সম্পদ কিনেছে, যার মূল্য দেড়শো মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি।”
আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে ব্রিটিশ এমপি বলেন, “কাতারভিত্তিক এই সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে, আমার নির্বাচনী এলাকা পপলার অ্যান্ড লাইমহাউজে সাইফুজ্জামান ৭৪টি সম্পদের মালিক। প্রশ্ন ওঠা এসব সম্পদের মালিক বাংলাদেশের জনগণ। আমি মনে করি, এসব সম্পদ বাংলাদেশের জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত সমাজের জন্য সংগ্রাম করছে তারা।”
এনএসির উদ্দেশে আপসানা বেগম বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান, কর্মক্ষেত্রের অধিকার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ওপর দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সর্বজনবিদিত।
“বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন সম্প্রতি আত্মসাৎ হওয়া তহবিল উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ অন্যান্যদের যুক্তরাজ্যে যেসব সম্পদ রয়েছে, সেগুলো তদন্ত ও জব্দের বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা যদি এনএসি পরিষ্কার করে, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।”
চিঠিতে এনএসি মহাপরিচালকের উদ্দেশে ব্রিটিশ এমপি বলেন, “আমি নিশ্চিত আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন, সম্পদ জব্দ ও বাংলাদেশে সেসব ফিরিয়ে দেওয়া কেবল ন্যায়বিচার ও বাংলাদেশের জনগণের অধিকারের ভবিষ্যতের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, একই সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সুনাম ও আন্তর্জাতিক অবদানের জন্যও অপরিহার্য।”