Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিএসএমএমইউতে এই সময়ে ২২৩ পদোন্নতি কেমন করে হলো

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
Picture of জাকিয়া আহমেদ

জাকিয়া আহমেদ

সহিংস এক আন্দোলনে সরকার পতনের পর অস্থিরতার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে দুই শতাধিক চিকিৎসকের পদোন্নতির একটি প্রজ্ঞাপন হয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের তিন দিন পর গত ৮ আগস্ট হওয়া এই প্রজ্ঞাপনে ১৭৩ জন চিকিৎসকের পদোন্নতি হয়। আরও ৫০ চিকিৎসককে ‘পার্সোনাল প্রমোশন’ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, এক্ষেত্রে তা না মানায় এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পদোন্নতি পাওয়া চিকিৎসকরা বলছেন, গত দেড় যুগের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এই পদোন্নতিকে তারা বৈধ বলেই মনে করছেন।

আর এই পদোন্নতির আদেশ দিলেও বিএসএমএমইউর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কেউ কিছু বলতে চাইছেন না।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৩-২০০৬ পর্যন্ত বিএসএমএমইউতে নিয়োগ পাওয়া ২০০ চিকিৎসক গত দুই দশকেও পদোন্নতি পাননি; যদিও এই চিকিৎসকদের অনেকেই দেশ ও দেশের বাইরে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পাশাপাশি পদোন্নতির নানা শর্ত পূরণ করেছেন।

এই চিকিৎসকদের মধ্যে ৪৫ জন পদোন্নতির দাবি নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন। তাতে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালত ১৯৯৯ সালের বিধি অনুযায়ী এই চিকিৎসকদের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি এবং তাদের পদায়ন নিয়মিত করার নির্দেশ দেয়।

পরের বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি নিয়ে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষে কাছে পদায়নের আবেদন করেছিলেন তারা। কিন্তু বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ আপিল করলে চলতি বছরের ৩ জুন সাবেক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের আদেশই বহাল রাখে।

এরপরও বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না করায় গত ৯ জুন এই চিকিৎসকদের কয়েকজন উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু তাতেও কোনও সুরাহা হয়নি।

এরপর জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে।

আন্দোলনের মধ্যে গত ৪ আগস্ট বিএসএমএমইউতে আগুন দেওয়া হয়, চলে ব্যাপক ভাংচুর। পরদিনই পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৫ অগাস্টের পর বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক তার কার্যালয়ে যাননি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার দুদিন পর গত ১০ আগস্ট তিনি বিএসএমএমইউতে যান তিনি। এরমধ্যেই ৮ আগস্ট রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল হান্নানের স্বাক্ষরে ১৭৩ জন চিকিৎসকের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন হয়।

বিএসএমএমইউয়ের একাধিক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কোনও ধরনের নিয়মের তোয়াক্কা না করে এই পদোন্নতি হয়েছে। যদিও এমন অরাজকতা আওয়ামী লীগের আমলেও হয়েছে। এখন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

“তবে এবার যা হয়েছে, সেটা নজিরবিহীন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কেউ এখানে উপস্থিত নেই, রেজিস্ট্রারকে জোর করে বাসা থেকে এনে তাকে দিয়ে এই প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে,” বলেন এক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, কেবল এই ১৭৩ জনই নয়, আরও ৫০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই ২২৩ জনের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।

“যে কোনও পদোন্নতির আগে আবেদন করতে হবে, বোর্ড ফেইস করতে হবে, প্রয়োজনীয় পেপার্স (পদোন্নতির চাহিদা অনুযায়ী) দিতে হবে। সিলেকশন হবে সিন্ডিকেটে। এরপর সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থাৎ সিন্ডিকেট অনুমোদন দিলে সেটা বাস্তবায়ন এবং কার্যকর হবে।”

তিনি বলেন, “পদোন্নতির এই প্রজ্ঞাপন অবৈধ। তারা এই পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করলে, সেটা হবে অবৈধ।”

রিট আবেদনকারী ৪৫ জন হলেও তাদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়েছেন। ফলে আদালতের আদেশের কথা যদি বলা হয়, সেই যুক্তিও ধোপে টেকে না সংখ্যার কারণে।

১৭৩ জনের সঙ্গে আরও ৫০ জন চিকিৎসকের ‘পার্সোনাল প্রমোশন’ হয়েছে। ‘পার্সোনাল প্রমোশন’ কী- জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, নিজ নিজ বিভগে পদ খালি থাকা সাপেক্ষে তার পদোন্নতি হবে, কিন্তু বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা আগের পদ অনুযায়ী থাকবে।

পদোন্নতি পাওয়াদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের গবেষণা সহকারী ডা. সাইফুল ইসলাম। তিনি সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। তিনি রিট আবেদনকারী ৪৫ জনের কেউ নন।

তাহলে কীসের ভিত্তিতে আপনার এই পদোন্নতি- এই প্রশ্নে ডা. সাইফুল বলেন, ২০০৬ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত তার কোনও পদোন্নতি হয়নি।

তিনি জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর গত ৭ আগস্ট উপাচার্যের কাছে পদোন্নতির আবেদন করেন তারা।

গত ৪ অগাস্ট বিএসএমএমইউতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর হয়।

কিন্তু অস্থির এই সময়ে এত দ্রুত এই পদোন্নতি নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ক্ষোভ, বঞ্চনা, ক্রোধের ফলে এটা হয়েছে।”

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে একই ব্যাচে পাস করে তারই বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এখনও মেডিকেল অফিসার, অথচ তার বন্ধু আওয়ামী লীগ করার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসি।

ডা. সাইফুল বলেন, তার পরে চাকরিতে যোগ দিয়েও আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চিকিৎসকরা একের পর এক পদোন্নতি পেলেন তার মতো অনেকে বঞ্চিত ছিলেন।

এভাবে পদোন্নতি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেক চিকিৎসকই। তাদের মধ্যে এমন চিকিৎসকই বেশি, যারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাচিপ কিংবা বিএনপি সমর্থিত ড্যাবের সমর্থক নন।

এক চিকিৎসক বলেন, “অথচ এখন পর্যন্ত তিনবার পরীক্ষা দিয়েছি। বর্তমান প্রশাসন কেবল নিয়ম দেখিয়েছে। কিন্তু এতটা মেরুদণ্ডহীন যে তারা বিএনপি, জামাতের পদোন্নতি দিয়ে দিল! নিয়ম তো মানলো না।

“আমরা যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপি করি না, কেবল চিকিৎসক হিসেবে রোগীর সেবা করতে চেয়েছি, তারা কি আজীবন মেডিকেল অফিসার হিসেবে থাকার জন্য এত কষ্ট করে ডিগ্রি নিয়েছিলাম?”

এবিষয়ে কথা বলতে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুল হান্নানের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন করলেও সাড়া দেননি তিনি।

তার এক সহকারী বলেন, “কী অবস্থায় পড়লে এই প্রজ্ঞাপন দিতে হয়েছে, সেটা বুঝতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীন মোহাম্মদ নুরুল হকের কোনও বক্তব্যও পাওয়া যায়নি। তিনি অফিসে আসছেন না। তিনি পদত্যাগ করতে পারবেন বলেও গুঞ্জন চলছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত