বাজেটে বরাদ্দের অঙ্কগুলোতে খুব একটা পরিবর্তন কি ধরা পড়ে? একটু খতিয়ে দেখলে যে কারও চোখেই ধরা পড়বে যে খুব একটা-হেরফের নেই। বলা যায়, উনিশ-বিশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন; বললেন, “আগের বাজেট যেভাবে চলে আসছে, সেখান থেকে সংখ্যার তারতম্য হয়েছে, কিন্তু বাজেটের প্রিন্সিপাল একই রয়ে গেছে।”
অথচ এই সরকার স্বাভাবিক সরকারগুলোর মতো নয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রক্তাক্ত এক অভ্যুত্থানের পথ পাড়ি দিয়ে গঠিত হয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকার। যে সরকারের কর্ণধাররা নিজেদের ‘অভ্যুত্থানের সরকার’ বলেই পরিচয় দেয়।
সেই সরকারের বাজেটে বৈষম্যবিরোধী কথা থাকার কথা, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের বাজেট বক্তৃতায় সে কথা আছেও। কিন্তু বৈষম্য নিরসনের কোনও দিক-নির্দেশনা কি আছে?
আওয়ামী লীগ আমলে বরাবরই সরকারের অর্জন হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে দেখিয়ে আসছিল। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে তা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছিল, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তারপর ধাক্কা আসে কোভিড মহামারির কারণে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। তারপরও প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাই ধরে আসছিল আওয়ামী লীগ সরকার, তা অর্জিত না হলেও। পতনের আগে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরেছিল শেখ হাসিনার সরকার, তবে অর্জিত হয় ৪ শতাংশেরও কম। এবার অন্তর্বর্তী সরকার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। বাজারের আগুনে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছেই। গত ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে গড় মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বলে বিবিএস হিসাব দিলেও বিআইডিএসের হিসাব তা ১৫ শতাংশ দেখাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য থাকলেও তা সম্ভবপর হয়নি। এবার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে ৪ স্বাস্থ্য খাতে ১ হাজার ৯০৮ কোট টাকার বরাদ্দ রেখেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, যা মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের জন্য অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিতে চলতি বাজেট থেকে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। গত বাজেটে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, যা ওই বাজেটের ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে রাখার কথা বলে এলেও তা হচ্ছে না কখনও।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে নতুন বাজেটের বরাদ্দ প্রস্তাব গত বাজেটের তুলনায় ৪৮০ কোটি টাকার বরাদ্দ কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খাতটিতে গত বাজেটের তুলনায় ৪০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ১২ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা, তথ্য প্রযুক্তির বিভাগের জন্য ২ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা এবং কারিগরি মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা উপদেষ্টা আগামী অর্থ বছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের জন্য ৩৮ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ৯ শতাংশ। গত বাজেটে এই খাতের বরাদ্দ ছিল ৩৮ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত এই বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ৩৪৩ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই খাতে ১৯ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতেও চলছে দুর্দশা। এছাড়া দাতা সংস্থার ঋণ ও সহায়তা প্রাপ্তিও সন্তোষজনক নয়। ডলার সংকটের কারণে সরকার প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আমদানি করতে পারছে না, বা আমদানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেও চলছে খরা, হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান।”
সালেহ উদ্দিন আহমেদ, অর্থ উপদেষ্টা
ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ
সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য