চিকিৎসা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজন যথাযথ অর্থ বরাদ্দ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই বরাদ্দের পরিমাণ হওয়া উচিত একটি দেশের জাতীয় বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশে তা কখনোই হয়নি জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাত এ দেশে বরাবরই উপেক্ষিত। আর বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় তা উপযুক্ত মানদণ্ড অনুযায়ী না হওয়ায় সেভাবে জনমানুষের কল্যাণেও আসে না।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পেশ করেছেন, তাতে স্বাস্থ্য খাতে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন তিনি।
এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য ৩০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের জন্য ১১ হাজার ২৮৩ কোটি বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার বরাদ্দ বেড়েছে তিন হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা বেশি।
তবে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়লেও আগামী অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে সার্বিকভাবে যে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা মোট বাজেটের মাত্র ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। বরাদ্দের এই পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানদণ্ডের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ এবারও উপেক্ষিত স্বাস্থ্য খাত।
তবে কথা এখানেই শেষ নয়। গত বাজেটে সাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সংশোধিত বাজেটে যা কমে ৪ দশমিক ১৬ শতাংশে নেমে আসে। এই হিসাবে, এবার ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা আরও কমবে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ বাড়বে
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট আমদানির জন্য নতুন এইচ কোড তৈরি করে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। আর চলতি বছরে ডেঙ্গুর তাণ্ডব দেখার আগে জানা গেল, ডেঙ্গু পরীক্ষায় ব্যবহৃত কিট আমদানির ওপর রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে করে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও কিডনি রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কিছুটা কমবে।
আপাতদৃষ্টিতে এটা ভালো খবর মনে হলেও হাসপাতালে ব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আমদানির শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত স্পাইনাল নিডলের নতুন এইচএস কোড তৈরি করে এতে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বাজেটে স্বাস্থ্যের বরাদ্দ নিয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একটু খানি বেড়েছে বাজেট, কিন্তু তাতে খুব বেশি আনন্দিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এই বাজেটে কত টাকা রোগ প্রতিরোধী খাতে ব্যয় হবে সেটা একদমই অনুপস্থিত।”
এই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে কোনও দিক নির্দেশনা নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দেশের মানুষের পকেট থেকে যে টাকা চিকিৎসার জন্য খরচ হয়, সেখানে কোনও তারতম্য হলো না বাজেটে, আর সেই খরচ কমানোর ইঙ্গিত নেই, উদ্যোগও নেই।
“এই জীবদ্দশায় দেখে যাচ্ছি, স্বাস্থ্যবাজেটের বেশিরভাগ অংশই হাসপাতালের অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনে ব্যয় হয়, আর যতটুকু বাকি থাকে সেটা মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারে না।”
বেসরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করে অধ্যাপক ফয়সাল বলেন, “এটা কেমন কথা হলো? ব্যক্তি পর্যায়ে তো খরচটা বেড়ে গেল।”
সরকারিতে আমাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেকেই নানা কারণে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে থাকেন। কিন্তু এখন তো ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ আরও বেড়ে যাবে। তাতে করে অনেকেই এত বেশি খরচ দেশে না করে দেশের বাইরে চলে যাবে। আর এতে দিনশেষে এই দেশের টাকা বাইরে যাচ্ছে।
“সবকিছু আসলে আরেকটু চিন্তা ভাবনা করা দরকার ছিল, যা আশা করেছিলাম সেটা হলো না।”
অর্থনৈতিক চাপের মুখে বাজেটে যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল, সেই অগ্রাধিকারগুলোর দেখা পাননি বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বিদিশা হক।
তিনি বলেন, “প্রতিবছরের মতো গতানুগতিক বাজেট। হয়তো কিছুটা ১৯/২০ হয়েছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি কাজের হবে না।
“এটা গতানুগতিক, ধারাবাহিক। নতুন কিছু হয়নি, সার্বিক বিচারে স্বাস্থ্য-শিক্ষা এখানে উপেক্ষিত। স্বাস্থ্য খাতে করোনার সময় বড় ধাক্কায় পরেও যেভাবে এখানে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দেওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি।”
মানুষের খাদ্য বর্হিভূত যে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম জানিয়ে অধ্যাপক বিদিশা হক বলেন, “বর্তমানে চিকিৎসা করাতে গেলে একজন ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয় বেশি, সরকারের খরচ কম। কিন্তু এখানে যদি সরকার কিছু করত, তাহলে সাধারণ মানুষের উপকার হতো।”
পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য বিষয়গুলোতে অন্য দেশগুলো গুরুত্ব দিয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্য দেশগুলো এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে, পাশের দেশ ভারতেও তাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া খরচের চেয়ে বাংলাদেশে বরাদ্দ অনেক কম। অথচ ভারত এতদিন ধরে যে বিনিয়োগ করেছে, তার সুফল তারা এখন পাচ্ছে।
“আমরা এমন কিছু ভাবি না, ফলে স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি,” বলেন তিনি।