তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে অল্প সময়ে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছেন জাহাজী লিমিটেডের অন্যতম উদ্যোক্তা কাজল আবদুল্লাহ। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে একটি মাঝারি উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন ও তহবিল উত্তোলনে সক্ষম হয়েছেন এই উদ্যোক্তা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতির পেছনে বাজেট সহায়তা বড় ধরনের ভূমিকা রাখে বলেই মনে করেন তিনি। তবে সেই সহায়তার প্রকৃত সুফল এখনও অধরা। এমনকি আরও কত নতুন দিগন্ত উন্মোচনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারত এই বাজেট, তা নিয়ে হতাশা ঝরে পড়ল এই উদ্যোক্তার কণ্ঠ থেকে। তবুও দমার নয়, কী করলে মিলবে প্রকৃত সুফল, সেই পথও দেখিয়ে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনান্স বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী।
সকাল সন্ধ্যা: প্রতি বছর সরকার বাজেট নির্ধারণ করে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি জাতীয় বাজেট নিয়ে কী ভাবেন? এবারের বাজেট নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
কাজল আব্দুল্লাহ: একটি মাঝারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হিসেবে বাজেট নিয়ে আমার বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকে। স্টার্ট-আপদের জন্য কর অবকাশ সুবিধার বিষয়টি খুবই সাধারণ একটি প্রত্যাশা। তবে আমি চাইব ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য, যা দেশকে ব্র্যান্ডিং করে, সেই সব পণ্য উৎপাদনের জন্য কিছু কাঁচামাল আবার আমদানি করে আনতে হয়। এই কাঁচামাল আমদানির জন্য ৫০ থেকে ৫৮ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়। কিন্তু কোন কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে প্রতিনিধিত্ব করবে, বা কোন কাঁচামাল কী উদ্দেশ্যে আনা হচ্ছে, তা আলাদা করে শুল্ক-কর নির্ধারণ করলে অনেকগুলো খাত এ থেকে উপকৃত হতে পারে।
সকাল সন্ধ্যা: একজন উদ্যোক্তা হিসেবে বাজেটের কোন বিষয়গুলো আপনার দৃষ্টিগোচর হয় বেশি। কেন হয়?
কাজল আব্দুল্লাহ: আমার যেহেতু প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা, স্বাভাবিকভাবেই আইটি পণ্য বা আইটি খাতে কী কী সুবিধা মিলছে বা নতুন কোনও দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে কি না, সেটাই বাজেটে খুঁজতে থাকি। বাজেটের একটি শৈল্পিক দিক থাকা দরকার। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শৈল্পিক দিকগুলো বাদ হয়ে কপি-পেস্ট পর্যায়ে চলে গেছে। এই বিষয়টি অনেক হতাশ লাগে।
সরকারের এখন ভিশন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া, ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এই ভিশনের সঙ্গে সরকারের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের একটি যোগসূত্র থাকতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের যত ধরনের টুলস আছে, বাজেটে সেগুলোকে এমনভাবে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে এই ভিশন বাস্তবায়নে কোনও বাধা তৈরি না হয়।
সকাল সন্ধ্যা: বাজেট কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন। বর্তমান প্রক্রিয়ায় কি কোনও পরিবর্তন আনা দরকার আছে বলে আপনি মনে করেন।
কাজল আব্দুল্লাহ: বহুবছর ধরেই বাজেট নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে একই ধরনের উপস্থাপন দেখছি। এখানে আরও আধুনিকত্ব আনার দরকার আছে। কারণ জনগণ সংবাদ মাধ্যমের ব্যাখ্যা পড়ে বা দেখেই বাজেট বুঝতে শেখে। এসব ব্যাখ্যায় আরও বেশি নতুনত্ব আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তাছাড়া জনগণও বাজেটের কিছু সাধারণ ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। যেমন, কালো টাকা সাদা করা, আয়কর সীমা বাড়ানো বা ফ্ল্যাট কিনলে কর ছাড় পাওয়া যাবে কিনা। এরকম তিন-চারটি টপিক নিয়েই তারা থাকে। কিন্তু বাজেট অনেক বড় একটি শিল্প। এটা একটি কবিতা লেখার মতো। এটা ঠিকভাবে লিখতে পারলে তা দেশের ভবিষ্যত গড়ে দিতে পারে। সেটা হয় না বলে অনেক হতাশ লাগে।
সকাল সন্ধ্যা: স্টার্ট-আপের উন্নয়নে সরকার বাজেটে কিছু উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে সেই উদ্যোগের প্রকৃত সুফল কি মেলে? এ খাতের বরাদ্দের সুফল পেতে হলে কী করা দরকার?
কাজল আব্দুল্লাহ: বাজেটে স্টার্ট-আপদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হয়। বরাদ্দ রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও স্টার্ট-আপ ঋণ নিয়ে অনেক গালভরা বুলি আওড়ায়। কিন্তু আমি যখন এই ঋণের জন্য ব্যাংকে যাই, তখন দেখেছি ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়। একটা ব্যাংকও স্টার্ট-আপদের ঋণ দিতে রাজি না। বন্ধক দেওয়ার তো সুযোগ থাকে না স্টার্ট-আপদের। এরপর এত ধরনের কাগজপত্র চায়! পুরো জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সবার নথিপত্র আর সই-স্বাক্ষর এক জায়গায় করা লাগে। এখানে কথায় কাজে আসলে কোনও মিল নাই।
সকাল সন্ধ্যা: কেবল উদোক্তা নয়, একজন নাগরিক হিসেবে সামগ্রিক বাজেট কেমন হওয়া দরকার। কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার?
কাজল আব্দুল্লাহ: একটি দেশের দুই ধরনের ভিশন থাকে, স্বল্পমেয়াদি ভিশন ও দীর্ঘমেয়াদী ভিশন। দীর্ঘমেয়াদি ভিশনকে লক্ষ্য রেখেই স্বল্পমেয়াদী নির্ধারণ করতে হয়। এর বাইরেও বর্তমানে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, ডলারের সরবরাহ কম থাকায় জাতীয় পর্যায়ের কিছু সংকট তৈরি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে এই বাজেটে কোন কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ, সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য কোন কোন পদক্ষেপ দরকার, সেটা নির্ধারণ করা একজন দল যোগ্য অর্থনীতিবিদদের কাজ। অনেক সুক্ষ্ম বিষয় আছে যে বিষয়ে একটি ছোট সিদ্ধান্ত নিলে তার একটি বাটারফ্লাই ইফেক্ট দেখা যেতে পারে, সেই বিষয়গুলোই বাজেটে থাকতে হবে।
একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা, যোগ্য অর্থনীতিবিদদের একটি দলের সমন্বয়ে এই বাজেট প্রণয়ন করা দরকার। দেশের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে রেখে সামষ্টিক পরিবর্তন আনা দরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আমরা কোনও কিছুতে হাত দিতে চাই না।