পাঁচ বছর আগে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের দায়ে ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ডই বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। বহাল থাকছে বাকি পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন সাজার রায়ও।
আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল এবং জেল আপিলের শুনানি নিয়ে
বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ রবিবার এই রায় দেয়।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আলোচিত এই হত্যা মামলায় ২৫ আসামিদের মধ্যে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রায় দিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।
বিচারিক আদালতের সেই রায়ই বহাল রাখল হাই কোর্ট। এখন মামলাটি চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আপিল বিভাগে গড়াবে।
রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আবরার ফাহাদের বাবা মো. বরকত উল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এ রায়ে আপাতত সন্তুষ্ট। এই রায়ের পরে পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে রায় যেন কার্যকর করা হয়, এটি আমাদের প্রত্যাশা।”
সন্তান হত্যাকাণ্ডের পর বরকত উল্লাহ মামলাটি করেছিলেন। রায়ের সময় তার সঙ্গে ছোট ছেলে আবরার ফাইয়াজও হাই কোর্টে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে আপিল বিভাগে আপিল করব।”
আবরার হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত ২৫ জনের সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের আগস্টে এই ছাত্র সংগঠনটি নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে দেখা দেওয়া আবরারকে এই বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের ২০ আসামি
এই মামলায় সর্বোচ্চ সাজা পাওয়া আসামিরা হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ)।
এছাড়া ছাত্রলীদের সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।
গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে যে, তাদের মধ্যে আবরার হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মুনতাসির আল জেমিও রয়েছেন। এখন পর্যন্ত জেমির বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।
জেমি ছাড়াও পলাতক রয়েছেন মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল), এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ) ও মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ)।
যাবজ্জীবনের ৫ আসামি
বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
মামলা পরিক্রমা
ফেইসবুকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখিকে কেন্দ্র করে আবরারকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী হিসাবে চিহ্নিত করে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ব্যাপক মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাতে প্রাণ হারান এই তরুণ।
কুষ্টিয়ার ছেলে আবরার বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি থাকতেন শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আবরারের সেই হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদের ঢল নেমেছিল। বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে বেশ কিছুদিন অচল হয়েছিল ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বুয়েট থেকে বহিষ্কারের পর শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফেরে।
আবরারের বাবা ব্যাংকার বরকত উল্লাহ কুষ্টিয়া থেকে এসে ছেলের লাশ গ্রহণ করে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকার চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন।
আলোচিত মামলাটি দ্রুত তদন্ত শেষে পরের মাসের ১৩ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান। এতে আসামিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ জনে।
সেই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়। আওয়ামী লীগের শাসনকালেই দুই বছরের মাথায় মামলার রায় হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের এক মাসের মাথায় ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য বিচারিক আদালতের রায়সহ যাবতীয় নথিপত্র হাই কোর্টে এসে পৌঁছায়।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদন লাগে; এটি ডেথ রেফারেন্সে নামে পরিচিত।
পাশাপাশি আসামিরাও দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে নিয়মিত ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। সবগুলো আবেদন একসঙ্গে হাই কোর্টে শুনানি হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির উদ্যোগ নেয় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। এরপর গত ১০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানির সূচনা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে পেপারবুক থেকে পাঠ করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে বি রুমি; তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সুমাইয়া আজিজ ও জামিউল হক ফয়সাল।
অন্যদিকে, আসামিদের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু, মাসুদ হাসান চৌধুরী, মোহাম্মদ শিশির মনির।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মামলার ডেথ রেফারেন্স, নিয়মিত আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) তালিকায় রেখেছিল আদালত। এরপর রবিবার এটি রায়ের কার্যতালিকায় আসে।
রায়ের প্রতিক্রিয়া
নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে আমরা সন্তুষ্ট। আবরার ফাহাদের বাবা আমার পাশে বসে আছেন, আমরা মনে করি উনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে।
“এ ধরনের রায়ের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ডিসিপ্লিন আনার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের যে ধারণা তা আদালতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ রায়ের মাধ্যমে একটি বার্তা গেল যে আপনি যত শক্তিশালী হন না কেন, আপনার পেছনে যত শক্তিই থাকুক না কেন, সত্য একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।”
হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নিম্ন আদালত তার রায়ে যে ফাইন্ডিং দিয়েছে, যে ভিত্তি স্থাপন করেছে, সেখানে কোনও হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, “আজকের প্রদত্ত রায়ে আমি আনইজীবী হিসেবে সংক্ষুব্ধ। আমি মনে করি, যে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছিলাম সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী ন্যায়বিচার আমরা পাইনি। রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর এর বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব।”
রায়ে সস্তোষ প্রকাশ করে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, “ছাত্রদেরকে বাবা-মা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছে। এঘটনায় কোনও বাবা-মায়ের দোষ নেই। ছেলেরা এসে যদি এভাবে নির্মমতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তো বাবা-মায়ের কষ্ট লাগে। ছাত্রদের প্রতি আমরা আহ্বান থাকবে, তারা যেন এ সমস্ত অপরাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হয়।”
রায়ের বিষয়ে আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী হাই কোর্ট থেকে এত বড় একটা রায় আসবে, তা আমরা ৫ আগস্টের আগে চিন্তাও করিনি। এটা অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সম্ভবপর হয়েছে।”
তবে রায় কার্যকরের জন্য এখনও অনেকগুলো পদক্ষেপ বাকি থাকার বিষয়টি দেখিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, “সেসব যেন দ্রুত সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করা হয়। সেটা আমাদের চাওয়া থাকবে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, আপিল বিভাগে আসামিপক্ষের সমস্ত আইনগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে এ মামলার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান তারা।