ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চার বছর পর আবারও আন্দোলনে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। পাঁচ দফা দাবি তুলে তা পূরণে রোববার পর্যন্ত প্রশাসনকে সময় বেঁধে দিয়েছে তারা। নইলে পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা তারা দিয়েছে। এদিকে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে সময় চেয়েছে প্রশাসন।
হঠাৎ কেন আন্দোলন
শিক্ষার্থীদের হঠাৎ আন্দোলনে নামার কারণ বুয়েটে ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি। বলা হচ্ছে, গত বুধবার রাতে সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে বুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম।
সেই ঘটনা জানার পর শুক্রবার জুমার নামাজের পর শুরু হয় বিক্ষোভ। বেলা আড়াইটা থেকে রাত পৌনে ৮টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, বুয়েট ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা রয়েছে, ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে গিয়ে তা লঙ্ঘন ঘটানো হয়েছে।
প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বুয়েটে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা বন্ধ রয়েছে ২০১৯ সালের অক্টোবরে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে। ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর পিটুনিতে মারা গিয়েছিলেন আবরার। তার মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিল বুয়েট প্রশাসন।
আবরার হত্যাকাণ্ডের মামলায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। পাঁচজনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ছাত্রলীগের এই নেতা-কর্মীদের বুয়েট থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের কী দাবি
শুক্রবারের বিক্ষোভ থেকে পাঁচ দফা দাবি তোলে শিক্ষার্থীরা। শনিবার আবারও বিক্ষোভ করে তারা, তখন দাবিগুলোতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে আবার তুলে ধরা হয়।
দাবিগুলো হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে বুধবার মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার; তার সঙ্গে জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীকে (এ এস এম আনাস ফেরদৌস, হাসিন আরমান নিহাল, অনিরুদ্ধ মজুমদার, জাহিরুল ইসলাম ও সায়েম মাহমুদ) বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে এবং হল থেকে বহিষ্কার; জড়িত অন্যদের অবিলম্বে শনাক্ত করে শাস্তি দেওয়া; ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থার বিষয়ে প্রশাসনের লিখিত নোটিস ও বাস্তবায়ন; দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) পদত্যাগ; আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনও রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি।
কর্মসূচি কী
শুক্রবার বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করার পর ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বিক্ষোভে ছিল তারা।
শনিবার সকালে আবার তারা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে ফেরে। এদিনের সব পরীক্ষা তারা বর্জন করে।
এদিন ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলনে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “গতকাল আমাদের আন্দোলনের পর তথাকথিত রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু ব্যক্তিবর্গকে ফেইসবুকে পোস্ট করে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে অপপ্রচার চালাতে দেখি। আমরা তাদের এমন বক্তব্যের ধিক্কার জানাই।
“আমরা সবসময়ই বুয়েটের সংবিধানে থাকা ‘বুয়েটে সকল রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’- এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সংঘবদ্ধ এবং যে কোনও মূল্যে বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর।”
বক্তব্যে আরও বলা হয়, “আমরা আবারও সুস্পষ্ট করে বলতে চাই, আমাদের এসকল দাবি কেবল কোনও বিশেষ ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়; বরং আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বুয়েটের সংবিধান অনুযায়ী সকল রকম ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছি।”
সংবাদ সম্মেলন শেষে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। তাদের মুখে স্লোগান ছিল- ছাত্র রাজনীতির ঠিকানা এই বুয়েটের হবে না’, ‘আবরার ফাহাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কর্মসূচি শেষ করার সময় হুঁশিয়ারি দেয়, দাবি না মানলে রোববারের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করবে তারা।
কী ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন
শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুয়েট প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে এই সিদ্ধান্ত জানায়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সার্বি বিষয় তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের টার্ম/সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম যথারীতি চলবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
যা বললেন উপাচার্য
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর বেলা ১টার দিকে নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেও সময় চান।
তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে আমরাও সহমত। কিন্তু এগুলো পূরণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য সময় প্রয়োজন।”
তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “বহিষ্কার শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক ডেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করতে হবে। শৃঙ্খলা কমিটির সভার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন লাগবে। তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া শৃঙ্খলা কমিটি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবে না।
“এভাবে শাস্তি দেওয়া হলে আদালতে গিয়েও টিকবে না। ফলে তদন্ত লাগবে এবং তদন্তে অভিযুক্তকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। আমাদের আইন ও নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে।”
গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ছয় সদস্যের এই কমিটিকে আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বর্জনের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “আমরা পরীক্ষা স্থগিত করিনি। তারা (শিক্ষার্থী) বর্জন করেছেন। তারা পরীক্ষা স্থগিতের আবেদনও করেননি। তারা আবেদন করলে আমরা বিবেচনা করতাম।
“তারা এখানে ভুল করেছেন। পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু তারা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী ঘণ্টা বাজবে, ছাত্ররা আসুক না আসুক—এমন ঘটনা বুয়েটে আগেও ঘটেছে। পরে তারা পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে একাডেমিক কাউন্সিল বিবেচনা করতে পারে।”
ডিএসডব্লিউর পদত্যাগের দাবির বিষয়ে উপাচার্য সত্য প্রসাদ বলেন, এমন কিছু প্রশাসন ভাবছে না।
“ডিএসডব্লিউ বলেছেন, তার পক্ষ থেকে কোনও গাফিলতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা দাবি করতেই পারেন। কিন্তু দাবির মুখে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। সময় হলে আমরা নতুন ডিএসডব্লিউ নিয়োগ দেব।”
মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাদের ঢোকার বিষয়ে দায় তাহলে কার- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, “নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে আমরা কারণ দর্শানোর নোটিস দেব যে কেন তিনি ঢুকতে দিলেন। তার তো ঢুকতে দেওয়া উচিৎ হয়নি।
“কে ঢুকেছে, তাকে তো আগে চিহ্নিত করতে হবে। চিহ্নিত না করে তো শাস্তি দেওয়া যাবে না। তার জন্য সময় প্রয়োজন। যদি কোনও নিরাপত্তারক্ষী বহিরাগত ব্যক্তিদের ঢুকতে দিয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করলে ব্যবস্থা নিতে দেরি কেন- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “দাবি পূরণ করার জন্য যা যা করার, করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারব না। সবকিছু করার জন্য সময়ের প্রয়োজন।”
ছাত্রলীগের কী বক্তব্য
বুয়েটে এখন যে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে ইসলামী ছাত্রশিবিরের মদদ রয়েছে বলে দাবি করছে ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম প্রান্ত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আন্দোলনের নামে যে ঘটনা ঘটছে, এগুলো হটকারী। সেখানে মৌলবাদীরা আছে। ছাত্রশিবির আছে। এ বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল আছি।”
ছাত্রলীগ নেতা রাহিমের সিট বাতিলের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “কোনও তদন্ত ছাড়া ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করা হয়েছে। এগুলো কীসের ভিত্তিতে হয়েছে?”
বুয়েট নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্রলীগ কোনও কর্মসূচি দেবে কি না- জানতে চাইলে প্রান্ত বলেন, “এ বিষয়ে এখনেও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”