Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

৯ তলার ফ্ল্যাটে ১ গুলিতেই আহত হন দুই বোন

গুলিতে আহত মুমতাহিনা নাজ। পাশে তার মা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গুলিতে আহত মুমতাহিনা নাজ। পাশে তার মা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

বাসার ওপর দিয়ে তখন ক্রমাগত হেলিকপ্টার উড়ছে। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ আর টানা গুলির শব্দ।

এ অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মুমতাহিনা নাজ(১৭)। ৭ তলা থেকে একই ভবনের ৯ তলায় খালার ফ্ল্যাটে চলে যান। সেখানে শোওয়ার ঘরে দাঁড়িয়ে খালার সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে মুমতাহিনার পায়ে। শুধু তাই নয়, ওই গুলিতেই আহত হন খালাতো বোন আয়েশাও(১২)।

গুলিটি মুমতাহিনার ডান পায়ে আঁচড় কেটে বাম পায়ের হাঁটুর এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তারপর পাশে দাঁড়ানো খালাতো বোন মহসিনা আফনান আয়েশার পায়ে লাগে।

এই একটি গুলি মুমতাহিনার বাম পায়ের হাঁটুর হাড় কয়েক টুকরা করে দেয়, আর আয়েশার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশের হাড় ভেঙে দেয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে শুরু হওয়া আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। ওই দিন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বসিলায় ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ের এ ব্লকের ৪ নং সড়কের একটি ভবনের ৯ম তলার ফ্ল্যাটে গুলিবিদ্ধ হন মুমতাহিনা ও আয়েশা।

গুলিবিদ্ধ মহসিনা আফনান আয়েশা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

রবিবার দুপুরে বাসায় গিয়ে বিষন্ন মুমতাহিনাকে পাওয়া যায় বিছানায়। ২৫ দিন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গত ১১ আগস্ট বাসায় ফিরেছেন তিনি। কারও সহায়তা ছাড়া নিজে নিজে উঠেও বসতে পারছেন না। এরপর থেকে বিছানাতেই কাটছে তার দিন রাত।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের বেইলি রোড শাখার এইচএসসির পরীক্ষার্থী মুমতাহিনা নাজ। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ একজন ব্যবসায়ী। আর মা শাহনাজ বেগম চাকরি করেন ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে।

একই স্কুলের ধানমন্ডি শাখায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন আয়েশা। তার একটি ছোট বোনও আছে। ৬ বছর আগে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান আয়েশার বাবা মোহাম্মদ আলী ভুইয়া। এরপর থেকে মা জীবন নাহার জলিও একটি ৫ তারকা হোটেলে চাকরি করে দুই মেয়েকে লালন পালন করছেন।

মুমতাহিনা জানান, সেদিন বসিলা সেতুর মুখে সড়কে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। বিকাল ৫টার দিকে পুলিশ তাদের দিকে গুলি করতে শুরু করে। একই সময়ে এই এলাকার ওপরে হেলিকপ্টারও ঘনঘন চক্কর দিতে শুরু করে। তখন হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হচ্ছিল, পাশে থাকা র‌্যাব-২ এর ক্যাম্পের ছাদ থেকেও গুলি করা হচ্ছিল।

মুমতাহিনা বলেন, “এসব দেখে ভয়ে আমাদের ৭ তলার ফ্ল্যাট থেকে ৯ তলায় খালার ফ্ল্যাটে চলে যাই। সেখানে শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে খালার সঙ্গে কথা বলার সময় একটি গুলি এসে লাগে আমার আর আয়েশার পায়ে।”

বাসার ভেতরে শোবার ঘরে থেকেও গুলিবিদ্ধ হতে পারেন তা কল্পনাতেও ছিল না মুমতাহিনার। কিন্তু গুলিটি হেলিকপ্টার থেকে নাকি র‌্যাব ক্যাম্পের ছাদ থেকে এসেছিল তা বুঝতে পারেননি। তিনি বলেন, “আমরাতো রাস্তায় যাইনি, তাহলে আমাদের এমন পরিণতি কেন হলো?”

বাসার বারান্দা থেকে দেখা যাওয়া সামনের অংশ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

একই ভবনের নয় তলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায় চেয়ারে বসে ভাঙা পা টেবিলের ওপর তুলে রেখেছে আয়েশা। আয়েশা বলেন, “সেদিন মুমতাহিনা আপু এসে আমাদের সবাইকে সাবধানে থাকতে বলছিল। তখনই আমরা গুলিবিদ্ধ হই। গুলি বাসার বারান্দা পেরিয়ে জানালা দিয়ে এসে আমাদের পায়ে লাগে।”

জুলাইয়ের শুরুতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মাসের মাঝামাঝিতে সেই আন্দোলন গড়ায় সহিংসতায়। শিক্ষার্থী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে প্রাণ হারান অনেক ছাত্র-জনতা, আহতও হন অনেকে। এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মুমতাহিনার পায়ে ২ বার অপারেশন হয়েছে। ৪টা রিং আর শিক লাগানো হয়েছে। ১৫ দিন পর আবার মুমতাহিনাকে হাসপাতালে যেতে বলেছেন চিকিৎসক। তখন হয়তো বোঝা যাবে পায়ে লাগানো রিং ও শিক কতদিন পর খোলা যাবে।

শারিরীক পরিস্থিতিতে মুমতাহিনার কষ্ট তো আছেই, তবে তার উদ্বেগ বেশি সৃষ্টি হয়েছে পড়াশোনা নিয়ে।

বন্যার কারণে সিলেট বিভাগের চার জেলা বাদে সারাদেশে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় গত ৩০ জুন। এরপর সম্পন্ন হয় ৭টি বিষয়ের পরীক্ষা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর কয়েক দফায় বাকি ৯ দিনের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এখন আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকি থাকা পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তাতেই কিছুটা উদ্বিগ্ন মুমতাহিনা।

তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যেতো আমার সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়। উঠে বসতেও পারিনা এখন।”

এমন পরিস্থিতিতে ‘আলাদা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করার’ অথবা ‘যেসব পরীক্ষা দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে রেজাল্ট দেওয়ার’ দাবি করেন তিনি। মুমতাহিনা চান না কোনোভাবে তার পড়ালেখা থেমে যাক।

সেদিনের বিভৎস স্মৃতি এখনও ভুলতে পারছেন না মুমতাহিনার মা শাহনাজ বেগম। গুলিবিদ্ধ মেয়েকে নিয়ে যখন হাসপাতালে ছিলেন দেখেছেন অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন,  অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়ের পা কেটে ফেলা হচ্ছে। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এসব দেখে খুব ভয় পেয়ে যাই। ডাক্তারদের হাতে পায়ে ধরে বলি, আমার মেয়ের পা কাটবেন না। এক ডাক্তার অভয় দেন যে, পা কাটবেন না।”

১৫ দিনের হাসপাতাল জীবনে নিজের চোখে যেসব চিত্র দেখেছেন, তারপর শাহনাজ বেগমের আবেদন, “নতুন সরকার যেন এসব ছেলেমেয়েদের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।”

এসএসসির পর পাওয়া মুমতাহিনার ক্রেস্টগুলো দেখান তার বাবা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন মুমতাহিনা। সেই মেয়ের পড়াশোনা যেন কোনওভাবেই বিঘ্নিত না হয় এটুকুই শুধু চাওয়া বাবা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদের।

দুই বোনকে হাসপাতালে নেওয়া ছিল আরেক যুদ্ধ

বসিলার ফ্ল্যাটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মুমতাহিনা ও আয়েশাকে আগারগাঁওয়ের পঙ্গু হাসপাতালে নিতে সময় লেগে যায় প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা। মাত্র ৪-৫ কিলোমিটার এই পথ যেতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হয় ৩৫ হাজার টাকা।

মুমতাহিনার বড় ভাই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফাহাদ মোহাম্মদ রিয়ন জানান, ওরা গুলিবিদ্ধ হয় বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে। আর হাসপাতালে নিতে বেজে যায় রাত ১১ টা।

আয়েশার পায়ের ভেতরে গুলি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

মুমতাহিনা ও আয়েশা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নাম্বারসহ শতাধিক জায়গায় ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারেননি। রিয়ন বলেন, “অবশেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মায়ের একজন সহকর্মী অ্যাম্বুলেন্স চালককে রাজি করাতে সক্ষম হন। কিন্তু সেই চালক ভাড়া হিসেবে ৩৫ হাজার টাকা চান। উপায় না দেখে আমরা তাতেই রাজি হয়ে যাই।”

উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও সেদিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে এলাকা দিয়ে যেতে দেয়নি পুলিশ। পরে বাধ্য হয়ে কেরানীগঞ্জ হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্স চালক তাদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন।

রিয়ন বলেন, “কিছুতেই মুমতাহিনার রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না। এ অবস্থাতেই তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসায় ফেলে রাখতে হয়েছে। পাশের ভবনে ভাড়া থাকা নার্সিংয়ের কিছু ছাত্রী এসে তাকে সেবা দেয়। তারা স্যালাইন দেওয়া থেকে শুরু করে রক্তপাত থামানোর চেষ্টা করে। তারা না থাকলে বিপদ আরও বড় হতে পারতো।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত