শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইসস্টিটিউটের নিচতলা। জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়াতেই কানে আসে ছোট্ট শিশুর চিৎকার। কান্নার আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখি বাবার কোলে দুই বছরের শিশু, যার বুক এবং দু’হাত মোড়ানো ব্যান্ডেজ। যন্ত্রণায় কাঁদছে শিশুটি, আর তার যন্ত্রণা উপশম করতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদছেন বাবা।
পরিবারটি কিছুটা ধাতস্থ হতেই এগিয়ে যাই, কথা বলি তাদের সঙ্গে।
জানা গেল, বাবার নাম সামসুল আলম, শিশুটির নাম রাব্বী।
সামসুল আলম বলেন, “ছেলেকে কোলে নিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। এসময়ে চুলা থেকে নামিয়ে আনা গরম ডালের বাটি পাশে রাখতেই তাতে হাত দেয় রাব্বী। গরমে ঝলসে যায় তার দুই হাতসহ শরীরের বড় অংশ। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা।”
জানালেন, গত ১০ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন করে এসে দেখিয়ে যেতে বলেছেন চিকিৎসকরা।
বার্ন ইনস্টিটিউটের এই জরুরি বিভাগ এমন একটি স্থান, যেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলেও মানসিকভাবে শক্ত হতে হয়। প্রায় সব বিছানাতেই রয়েছে পুড়ে বা ঝলসে যাওয়া রোগী, যার বেশিরভাগই শিশু। কারও ড্রেসিং চলছে, কারও স্যালাইন। কারও শরীর পরীক্ষা করে দেখছেন চিকিৎসক-নার্সরা। আর তাদের সম্মিলিত চিৎকারে জরুরি বিভাগজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক ‘ভয়ংকর অবস্থা’।
প্রতিবছরই শীতকালে দেশের হাসপাতালগুলোয় বেড়ে যায় আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীর সংখ্যা। যাদের অবস্থা বেশি গুরুতর, তাদের একটি বড় অংশ চিকিৎসা নিতে আসেন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।
হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. তারিকুল ইসলাম জানালেন, দশম তলায় শিশু ওয়ার্ডের দৃশ্য আরও মারাত্মক। গত জুনে কেবলমাত্র জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৩৯ জন রোগী, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল ১৮১। শীত শুরু হতেই মোট রোগীর পাশাপাশি বাড়তে থাকে শিশু রোগীর সংখ্যা।
পরিসংখ্যান বলছে, গত নভেম্বরে বার্ন ইনস্টিটিউটে মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৬৪ জন। যেখানে শিশু ছিল ৩৬৫ জন। আর ডিসেম্বরে মোট রোগী সংখ্যা বেড়ে হয় এক হাজার ১২৬ জন। তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৪৬১। অর্থাৎ মোট রোগী বাড়ার পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে শিশু রোগীর সংখ্যা।
১০ তলার শিশু ওয়ার্ডে মেয়ে প্রণালীর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন বাবা পবণ সূত্রধর। পিঠসহ শরীরের পেছনের অংশ পুরোটা ব্যান্ডেজ করা ছিল মেয়ের।
বেসরকারি চাকরিজীবী পবণ জানালেন, ঘটনার দিন সকালে চাঁদপুরের কচুয়ায় নিজেদের বাড়িদে চুলায় ভাত বসিয়ে প্রার্থনায় বসেছিলেন তার স্ত্রী। ভাত ফুটে বলক আসতে দেখে চুলার আঁচ কমাতে যায় সাত বছরের প্রণালী। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা, আগুন ধরে যায় তার পোশাকে।
গত ৩৫ দিন ধরে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি প্রণালী। প্রথম ২০ দিন করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) এরপর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়।
পবণ সূত্রধর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দিনরাত এক হয়ে গিয়েছিল, কীভাবে দিন কাটিয়েছি কেবল উপরওয়ালা জানেন। একেকসময় নিরাশ হয়ে পড়তাম। সিসিইউতে যেসব রোগী দেখেছি, নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা কঠিন।”
নিজে বিপদে পড়ে বুঝেছেন শিশুদের আগুন থেকে দূরে রাখা কতটা জরুরি, বললেন পবণ। সেজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে অনুরোধ করেন তিনি।
এই ওয়ার্ডেই দেখা গেল, দুই বছরের জবার পুড়ে যাওয়া পায়ে ফুঁ দিচ্ছেন মা পুতুল। জানালেন, চুলায় গরম ডাল ছিল। দুই ভাইবোন ঘরের ভেতরে খেলা করতে গিয়ে গরম ডালের কড়াইয়ের ওপর গিয়ে পড়ে। বরিশাল থেকে আসা এই মা ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে আছেন ১৩ দিন।
ডা. তারিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন ধরনের পোড়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী স্ক্যাল্ড বা তরল জাতীয় পোড়ার। শুধু তরল জাতীয় জিনিসের মাধ্যমে পুড়ে বা ঝলসে যাওয়া রোগীর সংখ্যা ডিসেম্বরে ছিল ৭১০ জন। যা বছরের অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এসব রোগীরা গরম চা, গরম দুধ, ভাতের মাড় এসবের মাধ্যমেই বেশি পুড়ছেন।
এরপরেই রয়েছে আগুনে পোড়া। শীতের দিনে পাতা-খড়কুটার মাধ্যমে আগুন পোহানো হয়। সেখান থেকেও অনেক দুর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবার আরেক ধরনের আগুনে পোড়া রোগী বেশি আসছেন সেটি হলো জমে থাকা গ্যাস থেকে আগুন। শীতকালে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমানো হয়। ঘরের গ্যাসের পাইপে কোনো লিক থাকলে তা ভেতরে জমতে থাকে। সকালে যখন চুলা জ্বালানো হয় তখন বড় বিস্ফোরণ হয়, পুরো পরিবার একসঙ্গে দগ্ধ হয়।
ডা. তারিকুল ইসলাম বলেন, “এবার প্রায় প্রতিদিনই এরকম রোগী পাচ্ছি। ধানমণ্ডি, কেরানীগঞ্জ, ফেনীতে এ ধরনের বড় ঘটনা ঘটেছে। এটা ভীষণ অ্যালার্মিং। কারণ, পুরো বাসাটাই একটা গ্যাস চেম্বার হয়ে যায়। তখন রক্ষা পাওয়ার আর কোনও উপায় থাকে না।
“আমরা সবসময় সবাইকে বলি, দিনের শুরুতে চুলা জ্বালানোর আগে দরজা-জানালা খুলে দিতে, অথবা রাতেও বাড়ির অন্তত একটা জানালা খুলে রাখতে। রান্নাঘরে পর্যন্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখতেও বলি। কিন্তু অনেকেই সেটা মানেন না। ফলে পুরো পরিবারের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়।”
শিশুদের পুড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন উৎস হিসেবে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ও চার্জারের কথা উল্লেখ করলেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, কেবল শীতকালের নয়, এটা সারাবছরেরই সমস্যা। আর এ ধরনের পোড়াগুলো সাধারণ চিকিৎসায় সারে না, অস্ত্রোপচার দরকার হয়। তাই অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শিশুদের পুড়ে যাওয়া রোধ করতে সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। রান্না করা যে কোনও গরম জিনিস, ইলেকট্রিক ডিভাইস শিশুদের হাতের নাগালে রাখা যাবে না।
“সেইসঙ্গে গরম পানি হাঁড়িতে করে গোসলখানায় না নিয়ে বালতি রান্নাঘরে এনে সেখানে পানি ঢেলে নিয়ে গেলে ঝুঁকি কম থাকে। খড়কুটো, পাতা দিয়ে আগুন পোহানোর অভ্যাস বাদ দেওয়া গেলে ভালো। আর বাদ দেওয়া না গেলে আগুন পোহানো শেষে অবশ্যই ভালোভাবে নিভিয়ে ফেলতে হবে।”
শিশুদের আগুন থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের সচেতনতার বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।