বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গানের তালিকায় চতুর্থ স্থানে ঠাঁই করে নিয়েছিল মান্না দে’র ‘কফি হাউস’ গানটি। গানটি শেষের কলি ছিল-
“সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই…”
১৯৮৩ সালে গাওয়া গানটির জন্মদাতারা হয়তো জানতেন না, কফি হাউসে একদিন আড্ডার নতুন কুঁড়িও ব্যস্ততার জন্য বেশিক্ষণ বসবে না, আর বেঁচে থাকার আপ্রাণ লড়াইয়ে কফি হাউসটাও নিজের অজান্তেই পাল্টে যাবে।
ব্যবসায়িক পট পরিবর্তনের এ যুগে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের আইকনিক ইন্ডিয়ান কফি হাউসেরও ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাহিত্যিক এবং সিনেমা আন্দোলনের জন্মস্থান— কফি হাউজের মূল পরিবর্তনটি হয়েছে এর গ্রাহকদের ধরনে।
আজকাল কফি হাউসে আসা বেশিরভাগ গ্রাহক মূলত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে এখানে আসেন। তাদের হাতে কম সময় থাকে। স্ন্যাকস এর মতো দ্রুত খাওয়া যায়- এমন কিছু অর্ডার করে দোকানটির গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ হতে চাওয়াটাই তাদের মূল লক্ষ্য।
নতুন এ গ্রাহকরা টেবিল-চেয়ারও খুব কম সময়ের জন্য দখলে রাখেন। তারা উঠে যাওয়ার পর সেখানে নতুন গ্রাহকরা বসার সুযোগ পান।
কফি হাউসও এখন এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা গ্রাহকের চেয়ে অল্প সময়ে বেশি খরচ করা গ্রাহক পাচ্ছে দেদারসে।
১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কফি হাউসের ব্যবসায়িক ভবিষ্যত ১৫ বছর আগেও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি পড়েছিল লোকসানের মুখে।
নতুন প্রজন্মের এ গ্রাহকদের কারণে সেটি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের মূল কফি হাউজে গ্রাহকদের বসার জায়গা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি সামনের পয়লা বৈশাখেই প্রথমবারের মতো কলকাতার বাইরে বহরমপুরে একটি শাখা খোলারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ইন্ডিয়ান কফি ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং কফি হাউসের বর্তমান পরিচালনাকারী মোহাম্মদ জাভেদ।
তিনি বলেন, “আগের চেয়ে অবস্থা অবশ্যই ভালোর দিকে। আগে নিচের তলায় আমাদের ৪৪টি টেবিল ছিল, এখন আমাদের ৫২টি। উপরের তলায় ৩৭টি টেবিল ছিল এবং এখন ৪২টি। গত দুই বছরেই এই ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কফি হাউসের সংস্কৃতি খুব বেশি বদলায়নি- কেবল প্রজন্ম পরিবর্তিত হয়েছে।”
মোহাম্মদ জাভেদ এই নিয়ে দ্বিতীয় দফা কফি শ্রমিকদের সমবায় সমিতির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ৩৫ বছর তিনি কফি হাউসেই ওয়েটারের কাজ করেছেন।
জাভেদের কথার মাঝখানেই নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মী কথা বলে ওঠেন, “এমনকি আমাদের কাজের সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন হয়েছে, এখানে আরও তরুণ-তরুণী আসছেন। আমরা আর গ্রাহকদের শুধু এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করি না। আপনি যদি এখানে সময় কাটাতে চান, তবে আপনাকে অর্ডার দিতে হবে। শুধু আড্ডা দেওয়ার জন্য আপনি অবিরামভাবে একটি টেবিল দখল করতে পারবেন না।”
একসময় কফি হাউসের এই ওয়েটাররাই আড্ডায় উৎসাহ দিতেন। নিজেরাও হয়ে যেতেন কোনও কোনও আড্ডার অংশ। কিন্তু ঐতিহ্যসচেতন কলকাতাবাসীর মতোই তাদেরও চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। সম্ভবত সময় এবং ঐতিহ্যের আর্থিক মূল্য তারা বুঝতে শুরু করেছেন। আর তাই ২০ রুপির এক কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাকে তারা নিরুৎসাহিত করেন।
সোশাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের অভূতপূর্ব উত্থানে যার যার নিজ ঘরে শুয়ে-বসেই আড্ডায় দেওয়া যায় এখন। আর এ কারণে মুখোমুখি আড্ডা দেওয়ার লোকও কমছে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মচারী অসীম কুমার চক্রবর্তী বলেন, “আমার কলেজের দিনগুলোতে, সেটি ছিল ১৯৮০ এর দশকের শুরুর দিকে, এমন সময় ছিল যখন আমরা এখানে পুরো দিন কাটাতাম। আক্ষরিকভাবে সারা দিন। আমি তাদের সবাইকে এখানে বসে থাকতে দেখেছি— সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে।”
অসীম এখনও কলেজের দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থনের জন্য পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে কফি হাউসে যান।
তিনি আরও বলেন, “হ্যাঁ, এখানে আর আগের মতো কোলাহল নেই এবং আগের তুলনায় ধূমপানও খুব কম লোক করছে।”
এ ধরনের পাব্লিক প্লেইসে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও, কফি হাউজে কর্তৃপক্ষ এখনো বাধা দেয় না- সম্ভবত পুরানা ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করেই এটিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
কফি হাউজেই তিন দশকের বেশি সময় ওয়েটার হিসেবে কাটিয়েছেন কাবুল। তিনি তার ব্যস্ততার কথা বলতে গিয়ে জানান, গ্রাহকরা অবিরত আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকেন। তাদের কারণে দম ফেলার সুযোগটুকু পান না- “আজকাল মানুষের হাতে সময় নেই। তারা আসে, খায় এবং চলে যায়। তাদের নষ্ট করার সময় নেই।”
৪০ বছর কফি হাউজে কাটানো মোহাম্মদ জাভেদকে জিজ্ঞাসা করা হলো- যে প্রতিষ্ঠানে এতোটা সময় কাটিয়েছেন সেখানে তার সবচেয়ে স্মরণীয় সময়কাল কোনটি?
উত্তরে তিনি বলেন, “কোভিড সময়কাল। এটাই ছিল সেরা সময়, কারণ কাউকে কাজে আসতে হয় নি।”
[‘দ্য হিন্দু’ অবলম্বনে]