নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিতসহ চার দফা দাবিতে দেশে সব চিকিৎসাকেন্দ্রে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ নামে এই কর্মসূচি চলাকালে বন্ধ থাকবে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা।
রবিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার আব্দুল আহাদ এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারসহ সব কিছুতেই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বহাল থাকবে।
তাদের ৪ দাবি হচ্ছে– অপরাধীদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা; ঢামেকসহ সারাদেশের হাসপাতালে আর্মিসহ সিকিউরিটি ফোর্স নিযুক্ত করা, যারা ২৪ ঘণ্টা অস্ত্রসহ নিয়োজিত থাকবে; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
কর্মবিরতির ফলে যে সংকটের সৃষ্টি হবে তার দায়ভার চিকিৎসকদের নয় বরং প্রশাসনের ওপর বর্তাবে বলে মনে করেন তিনি।
কারণ হিসেবে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে কাজে ফেরার পরেও প্রশাসনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টানেন এই চিকিৎসক। আর সে কারণেই সারাদেশে কর্মবিরতি ঘোষণা করা হচ্ছে বলে জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার রাতে তিন দফায় চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে রাতেই কাজ বন্ধ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। অন্য চিকিৎসকরাও তাদের কর্মবিরতিতে সংহতি জানালে রবিবার সকাল থেকে হাসপাতালের সব বিভাগে চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
হামলার বিষয় নিয়ে একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। এমনকি হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে আরেক রোগীকে কুপিয়ে আহত করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পরে সেই রোগীর মৃত্যু হলে, সেসময় থেকেই কাজ বন্ধ করে দেন চিকিৎসকরা।
রবিবার সকাল নাগাদ অন্য চিকিৎসকরাও তাদের সঙ্গে সংহতি জানান। ফলে সকাল থেকেই কার্যত হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একই সঙ্গে প্রতিবাদ হিসেবে চিকিৎসকরা তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারও বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন নার্সসহ অন্যরাও।
ডা. আব্দুল আহাদ তার বক্তব্যে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যেসব ঘটনা ঘটেছে, আমরা নিজের জীবন বাজি রেখে, সারা বাংলাদেশে কী পরিমাণ সার্ভিস দিয়েছি। ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে দিয়েছে। খাবার দিয়েছে, ২৪ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা দিয়েছে।
“আমরা ডাক্তার, আমরা মানবতার সেবক, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই অংশ।”
নিউরোসার্জারি বিভাগের আরেক চিকিৎসক সহকারী রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর বলেন, “আমাদেরকে ছাত্র-জনতার বিপক্ষে দাঁড় করানোর কোনও সুযোগ নেই। আমরা এই আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি। টাকা দিয়েছি, ওষুধ কিনেছি।
“আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ভাইদের বুকে আগলে রেখেছিলাম, এখনো রাখছি। সন্ত্রাসীদের কোনও ষড়যন্ত্রই আমাদের ছাত্র-জনতার মুখোমুখি করতে পারবেনা। আপনারা ডাক্তারদের সঙ্গে থাকুন। আমরা আপনাদের ভাই, আপনাদের বোন।”
এসময় চিকিৎসক-রোগীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।
ডা. শাহবিয়ার কবীর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুক্রবার রাতে মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্টের এক রোগীকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। তাকে শনাক্ত করার মতো কিছু ছিল না। সব নাকি অ্যাক্সিডেন্টের পর ‘মিসিং’ হয়ে গিয়েছে।
“যার কারণে তিনি ভর্তিই হন ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে, তার জিসিএস লেভেলই ছিল পাঁচ।”
চিকিৎসা বিজ্ঞানে গ্লাসগো কোমা স্কেল (জিসিএস) একটি ক্লিনিক্যাল স্কেল যা মস্তিষ্কের আঘাতের পরে একজন ব্যক্তির চেতনার স্তর নির্ভরযোগ্যভাবে পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। জিসিএস একজন ব্যক্তির চোখের নড়াচড়া, কথা বলার এবং তাদের শরীরের নড়াচড়া করার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়।
শুক্রবার রাতের সেই ঘটনার বিবরণ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সেই রোগীর মাথায় আঘাতের কারণে তার সিটিস্ক্যানসহ অনেক পরীক্ষারই দরকার হয়। কিন্তু সেগুলো করা হচ্ছিল না। এরপরও তার চিকিৎসা চলতে থাকে।
অস্ত্রোপচারের জন্য রক্ত ম্যানেজ এবং অপারেশনের আগে স্বজনদের বন্ড সই দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু তার দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। এরপর দুপুরের দিকে তার মৃত্যু হয়। পরে বিকালে স্বজন এবং বন্ধু পরিচয় দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যায় কয়েকজন।
এরপর সেই রোগীর স্বজনরা আরও কিছু লোক নিয়ে দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে জরুরি বিভাগে আসে। সেসময় বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার চলছি। তারা অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকে এক আবাসিক চিকিৎসককে মারধর করে। ওই চিকিৎসককে সাহায্য করতে আরেক চিকিৎসক এগিয়ে গেলে তাকেও মারধর করা হয়।
এমনকি দুই চিকিৎসককেই হাসপাতালের পরিচালকের সামনে মারধর করা হয়েছে অভিযোগ করে ডা. শাহবিয়ার কবীর বলেন, একজন চিকিৎসক এতটাই আহত হয়েছেন যে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না দিলেও নিহত রোগীর পক্ষে যারা এসেছিল তাদের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন বলেও অভিযোগ করেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার, মামলা ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি জানিয়ে ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, “আমরা ইমার্জেন্সি সার্ভিস দিই, সেখানে কত শত রোগী থাকে। ইমার্জেন্সি সার্ভিস দেওয়ার জন্য আমাদের যথেষ্ট আর্মি, পুলিশ এবং অন্যান্য ফোর্স থাকতে হবে। অস্ত্রসহ তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল প্রশাসন এটা করতে ব্যার্থ হয়েছে।”
এই ঘটনার পর ঢামেক হাসপাতালে আরও দুটি ঘটনার কথাও জানান ডা. শাহরিয়ার।
তিনি বলেন, “খিলগাঁও এলাকার দিকে দুই পক্ষের মারামারি হয়। সেখান থেকে একজন রোগী আসে ঢাকা মেডিকেলে রাত ১১ টার দিকে। কিন্তু তাদের যে বিরোধী পক্ষ ছিল তারা জরুরি বিভাগে ঢুকে চাপাতি, রামদা নিয়ে আক্রমণ করে, সেই রোগীকে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায়।
“অথচ হাসপাতালের বাইরে তখন নিয়মিত নিরাপত্তাররক্ষীদের পাশাপাশি পুলিশ-সেনাবাহিনী ছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। এই যদি হয় ঢাকা মেডিকেলের ভেতরের অবস্থা, এখানে চিকিৎসক-রোগী কেউ নিরাপদ নন।”
এছাড়া, রাত একটার দিকে আরেকজন কিডনি রোগী আসেন, যার দুই কিডনিই বিকল বলে জানা যায়। অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কারণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “তার যখন চিকিৎসা চলছিল, চিকিৎসক পাকস্থলি পরিস্কার করছিলেন, তখন তার মৃত্যু হয়।
“সেই রোগীর স্বজনরা এসে জরুরি বিভাগের কাঁচের ঘর ভাঙচুর করে, নারী চিকিৎসককে হুমকি দেয়।”
শুক্রবার রাতের ঘটনার পর পরিচালকের অনুরোধে রাত ১১টার দিকে কাজে যোগ দেন জানিয়ে ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, “আমরা সকাল ৮টা পর্যন্ত ইমার্জেন্সি সার্ভিস দিয়েছি। হাসপাতালে আমরা ছিলাম। কিন্তু আমরা কোনও নিরাপত্তা ফোর্স এখানে দেখিনি। ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্সের সামনে নিরাপত্তা ফোর্স থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখি নাই। তাই আমরা বাধ্য হয়ে নিরাপত্তার জন্য আজ থেকে সারা দেশে কর্ম রিরতিতে যাচ্ছি।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘটনার রেশ না কাটতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে।
রবিবার সকালে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে রোগীর মৃত্যুর জের ধরে হামলার সূত্রপাত হয়। এসময় বেশ কয়েকজন চিকিৎসক হামলার শিকার হন, যার মধ্যে দুইজন নারী চিকিৎসক আছেন।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক ডা. শফিউর রহমান।
চিকিৎসকদের উপর হামলায় নিন্দা জানিয়ে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন এফডিএসআর।
সংগঠনের চেয়ারম্যান ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন ও উপদেষ্টা ডা. আব্দুন নূর তুষারের সই করার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রবিবারের মধ্যে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে সরকার ব্যর্থ হলে চিকিৎসক সমাজ বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।