সংস্কারের মাধ্যমে দেশের আইন বিচার ও প্রশাসনসহ সব ব্যবস্থায় সাম্য ফিরিয়ে আনার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা হাতছাড়া না করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
ঢাকার গুলশানে লেকশোর হোটেলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এই আহ্বান জানিয়েছেন।
আলোচনায় সাবেক অর্থ সচিব ও সাবেক মহা-হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মো. মুসলিম চৌধুরী বলেন, “আমাদের সংবিধানের কাঠামোতেই স্বৈরাচার তৈরি হওয়ার মতো অনেক উপাদান আছে। এমনকী ৭২ এর সংবিধানেও ছিল। এর পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন সংশোধনীর কারণে এটা ভেঙে গেছে।
“৯০ এর গণঅভ্যুত্থান ও ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য বেশকিছু রিকমেন্ডেশন রাখা হয়েছিল। কিন্তু এরপর নির্বাচন পরবর্তীতে যারাই ক্ষমতায় আসেন, তারা কেউ এসব রিকমেন্ডেশন বাস্তবায়ন করেনি।”
তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ এবার ছাড়া মানে আমরা বড় একটা কালো গর্তে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে। এই অপরচ্যুনিটি মিস করা যাবে না।
“এর আগে পাওয়া সুযোগটা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে। কিন্তু এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এবার আমাদের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া। সুতরাং এই সুফলটা আমাদের নিতেই হবে।”
“আমি মনে করি অনেকগুলো খাতেই সংস্কারের দাবি আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংস্কার করতে হবে আমাদের সুপ্রিম ল এর (সর্বোচ্চ বিচার ব্যবস্থা) সংস্কার। এবং এই সুপ্রিম ল কে এই কাঠামো থেকে অন্য কাঠামোতে নিতেই হবে। এটার মধ্যে যত রকমের স্বৈরাচার হওয়ার মতো যত রকমের উপাদান রয়েছে, সেগুলোকে সংস্কার করে সবগুলোকে কর্পোরেট কালচারে আনতে হবে।”
সংস্কারের অংশ হিসেবে স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে আলাদা করতে হবে এবং স্থানীয় সরকারেরও কিছু অংশে সংস্কার করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করে মুসলিম চৌধুরী বলেন, “এরপর এসব সংস্কার সংবিধানের মূল কাঠামোতে নিয়ে আসতে হবে।
“তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কারগুলো সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংশোধন করতে পারে। এর আগে ৯০ এর সংস্কার তারা সংশোধন করেছেও। তাই এবার যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংশোধন করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।”
স্থানীয় সরকার কমিশন, পুলিশ কমিশন, মানবাধিকার কমিশন এগুলোকে সংবিধানের ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তবে কনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্কের জন্য কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি, বা কনভেন ইস্যু এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আগে আলাপ করে ফেলতে হবে।”
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় যে অভূতপূর্ব বিরাট ঘটনা ঘটেছে—এটা একদিনে ঘটেনি, এটা আকাশ থেকেও পড়েনি। এটা দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফসল।
“আমি নিজেও সামান্য কিছু ভূমিকা রেখেছি, সুজনের পক্ষ থেকেও কিছু ভূমিকা রেখেছি।”
তিনি বলেন, “ছাত্র আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ- এটা চিহ্নিত করে তাদের বিচার হওয়া উচিত। সব খুনের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে।”
এসময় তিনি সেনাবাহিনীর হেফাজতে কারা আছে—তা জানানোর দাবি জানিয়ে বলেন, “তাদের হেফাজতে কারা আছে, তাদের তালিকা তৈরি করে আমাদের জানাতে হবে, যেন তারা পালিয়ে যেতে না পারে।
“আগের সরকার পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। এই বাাহিনীকে এখন সরকারি বাহিনীতে পরিণত করতে হবে। এই বাহিনীর সংস্কার এমনভাবে করতে হবে যাতে তারা আবার সরকারি বাহিনীতে পরিণত হতে না পারে।”
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় এই সেমিনারে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ব্র্যাকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিমম মাশরুর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া আলোচনায় প্যানেলিস্ট হিসেবে সাবেক অর্থ সচিব মুসলিম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “আজকে আমরা নতুন কোনও গবেষণাপত্র দিচ্ছি না। আমরা আজকে মূলত আমাদের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো কীভাবে নতুন করে সমাধান করা যায়—সে বিষয়ে সবার আলোচনা শুনতে চেয়েছি। সবার সুপারিশ নেওয়ার জন্যই আজকের এই ডায়ালগ।
“প্রচলিত সরকার ব্যবস্থায় আস্থাহীনতা এবং জনমানুষের বিপুল প্রত্যাশা- এই দুইয়ের সন্ধিক্ষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, “আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোতে যদি সমতা প্রতিষ্ঠিত হত, তাহলে সমাজের সব জায়গাতেই সমতা তৈরি হত। আমরা দেখতে পেয়েছি, দুর্নীতি যখন রাজনীতিতে ঢুকে গেল, তখন থেকে বাংলাদেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ সব জায়গাতেই দুর্নীতি ঢুকে গেল। আন্দোলনের আসলে প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে, দেশে এখন আমূল সংস্কারের প্রয়োজন আছে।”
আশু করণীয় হিসেবে তিনি বলেন, “ল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের জায়গাটা ঠিক করা সবার আগে দরকার। যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক করা সম্ভব হয়—তা যেন ২৫ ঘণ্টায় না যায়। রাষ্ট্রীয় খুন, গুম ও নির্যাতনের বিচার হওয়া দরকার অবশ্যই; এটা খুব জরুরি। মানুষের আশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারলে বাকি জিনিসেও সংস্কার করা সম্ভব হবে।”
কর্মসংস্থান ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করে আসছেন বিডিজবসের ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, “২৫ বছর আগে যখন আমি টেকনোলজি নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন আমার মনে হয়েছিল টেকনোলজি মানুষকে স্বাধীন করবে, তার হাতে পাওয়ার দেবে। এই মোহভঙ্গ হতে আমাদের বেশি সময় লাগেনি।
“আমরা দেখলাম মানুষকে স্বাধীনতা দেবে কীভাবে… এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। সবাই জানেন কীভাবে প্রযুক্তিগত গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।”
“আমার মনে হয়, প্রথমেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে গোয়েন্দা তৎপরতা, তা বন্ধ করতে হবে। এই ক্যাবিনেটে ৪ জন মানবাধিকার কর্মী আছেন তারা যদি এটা বন্ধ করতে না পারেন, তাহলে এটা কোনোদিন হবে না” বলেন মাশরুর।