লেবাননে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ভয়াবহ বিমান হামালা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে দেশটিতে অন্তত সাড়ে ৭শ’ মানুষ নিহত এবং প্রায় ১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে কার্যত ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর মধ্যে বিরোধ সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
সব মিলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত অক্টোবরে শুরু হওয়া সংঘাত এখন লেবানন হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এক জরুরি আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ তাদের বেশ কয়েকটি মিত্র দেশ ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তজুড়ে অবিলম্বে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।
এ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার।
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বিশ্বজুড়ে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও শুরু করেছে।
বুধবার গভীররাতে বাইডেন প্রশাসন শীর্ষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকদের নিয়ে জুমে বৈঠক আয়োজন করে। বৈঠকে সাংবাদিকদের ভিড় উপচেপড়ে। অনেক সাংবাদিককে ফিরিয়েও দিতে হয়।
বাইডেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটিকে বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেন।
তাদের দাবি, যে সংঘাত চলছে তা ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে। এমন সময় ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় দেশ এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সমর্থন লাভ একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন।
বাস্তবায়িত না হলেও বিশ্বশক্তিগুলোর এই যুদ্ধবিরতির আহ্বানকে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। কারণ এই প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের গাজায়ও যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রস্তাবে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহকে যুদ্ধ বন্ধ করে কূটনৈতিক উপায়ে তাদের বিরোধের মীমাংসা করার আহ্বান জানানো হয়।
এক্ষেত্রে তাদেরকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সমাধানের দিকে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
২০০৬ সালে ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল, যা কখনই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
তিন সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির আহ্বান ছাড়াও বুধবারের প্রস্তাবে পুরোনো কিছু আঞ্চলিক লক্ষ্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি লক্ষ্য প্রায় দুই দশক ধরে কূটনীতিকদের চেষ্টার পরও অধরাই রয়ে গেছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে যোগদানের জন্য নিউ ইয়র্কে জড়ো হয়েছেন বিশ্ব নেতারা। এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই নতুন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য সম্ভবত প্রস্তাবটির বিষয়ে বিশ্বজুড়ে জন সমর্থন তৈরি করা এবং ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ উভয় পক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
জুম বৈঠকে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ প্রস্তাবটিতে সমর্থন দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, “উভয় পক্ষের সঙ্গেই আমরা কথা বলেছি। আমরা মনে করছি, যুদ্ধবিরতি আহ্বানের এটিই সঠিক সময়। প্রস্তাবে কী আছে তা তারা জানে এবং আমরা শীঘ্রই তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারব।”
কিন্তু হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যোগাযোগ নেই। তাই সাংবাদিকরা আবারও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ উভয়েই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে কি না- তা জানতে চান।
জবাবে ওই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বিষয়টি পরিষ্কার করেন। তিনি জানান, ইসরায়েল ও লেবাননের সরকারের সঙ্গে প্রস্তাবটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিবিড়ভাবে কথা বলেছে। আর লেবানন সরকার হিজবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা লেবানন সরকার ও ইসরায়েলের সরকার উভয়ই যখন এটি মেনে নেবে, তখন এটি উভয়পক্ষের যুদ্ধবিরতি হিসেবেই কার্যকর হবে।”
তার ওই আশ্বাস বেশ আশাব্যাঞ্জক শোনালেও পরদিনই কূটনীতিকরা বৈরুতসহ লেবাননে আরও ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর আরও রকেট হামলার খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসেন।
যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা কি এবার কাজ করতে পারে
এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ এবং এটি কি আসলে যুদ্ধবিরতির দিকে নিয়ে যেতে পারবে?
প্রস্তাব পরবর্তী লক্ষণগুলো দেখে এখনও তেমনটা মনে হচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রওয়ানা করার আগে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি তার বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে লেবাননে হামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণেও তিনি ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবাননে হামলা অব্যাহত রাখার কথা জানান।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিও প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে তার স্বাক্ষর করার খবর প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটি ‘সম্পূর্ণ অসত্য’।
প্রস্তাবটিকে মূলত ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহকে থামানোর জন্য চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশ শেষ হবে ৩০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করবে।
এই প্রস্তাবের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই প্রথম ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে এবং প্রস্তাবে ‘তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে।
এর আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যত প্রস্তাব তোলা হয়েছে তার সবকটিতেই ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রও গাজায় যুদ্ধবিরতিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সমর্থন দিল।
গত অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তির চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু সফল হতে পারেনি।
এজন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন হামাস ও ইসরায়েলের ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার’ অভাবকে দায়ী করছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহকে দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
তবে আশার কথা হলো, ইসরায়েল-লেবানন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির মতো জিম্মি আলোচনা জড়িত নয়, যা গাজা চুক্তি নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু উভয় পক্ষের লক্ষ্য এখনও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরায়েল চায় তার উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত ৬০ হাজার বাসিন্দাকে ঘরে ফেরাতে এবং সেখানে হিজবুল্লাহর রকেট হামলা বন্ধ করতে।
অন্যদিকে, হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে চায়, যেখান থেকে প্রায় ১ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
এছাড়া হিজবুল্লাহ লেবাননে তার আধিপত্য ধরে রাখার পাশাপাশি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে তার উপস্থিতিও বজায় রাখতে চায়। পাশাপাশি লেবাননের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মধ্যে যেন গোষ্ঠীটির প্রতি আরও ক্ষোভ সৃষ্টি না হয় তাও নিশ্চিত করতে চায় হিজবুল্লাহ।
কিন্তু ইসরায়েল-লেবানন সঙ্কট নিয়ে ওয়াশিংটনের দূত আমোস হোচস্টেইন গত কয়েক মাস ধরে টেষ্টা করেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনও সমঝোতা করতে পারেননি।
আর এখানেই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কার্যকরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ উভয়ের উপর একাধিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে লিতানি নদীর দক্ষিণাঞ্চল থেকে সরে যাওয়াসহ হিজবুল্লাহর দীর্ঘমেয়াদে নিরস্ত্রীকরণ।
২০০৬ সাল থেকে উভয় পক্ষই একে অপরকে ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের শর্ত ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত করে আসছে।
তার মানে প্রায় দুই দশক ধরে কূটনীতিকরা যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তা এখন একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে মোড়ানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন চলমান কুটনেতিক প্রচেষ্টার এই চাওয়া একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
বিবিসিতে প্রকাশিত জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের করসপন্ডেন্ট টম বেইটম্যানের বিশ্লেষণ