Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

দিসানায়াকে কি পারবেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হতে

জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়াকে।
জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়াকে।
[publishpress_authors_box]

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে দক্ষিণ এশিয়া। ভারতের আমন্ত্রণে সেসময় দিল্লি যান শ্রীলঙ্কার বাম দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়াকে।

সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে দিল্লির জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরাও ছিলেন। 

ভারত সরকারের দিসানায়াকেকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাটি বেশ আলোচনা তৈরি করেছিল। কারণ এক সময়ের মার্ক্সবাদী এই নেতা ভারতবিরোধী হিসাবেই পরিচিত; ভারতের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গেই তার বেশি সখ্য। 

তার ওপর ৫৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিকের দল জেভিপি কখনও শ্রীলঙ্কা সরকারেই ছিল না। ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে রাজনৈতিক যে জোটের নেতৃত্ব দিসানায়াকে দিচ্ছেন, সেই জোটও কখনও ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রধান বিরোধী জোট নয়। ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে এই জোটের হাতে আছে মাত্র তিনটি আসন।

তাহলে দিসানায়াকের মতো একজন রাজনীতিককে ভারতের গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?

দিসানায়াকে এখন শ্রীলঙ্কার রাজনীতির উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি। সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে শ্রীলঙ্কায় যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা হচ্ছে। কয়েকটি জনমত জরিপ এমনও বলছে, ৩৮ জন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে দিসানায়াকের অবস্থান সামনের সারিতে।    

এসব কারণেই আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার ভারত বাধ্য হচ্ছে, দিসানায়াকের সঙ্গে বৈঠকে বসতে, তার ভারতবিরোধী অবস্থান জানার পরও। 

শ্রীলঙ্কায় এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসে, আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।    

দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে অনুরা কুমারা দিসানায়াকে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারেকাছে কখনও না থাকা এবং শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাতে দু দুবার বিপ্লবের ডাক দেওয়া দিসানায়াকের দল জেভিপির এখন নির্বাচনে জিতে দেশ শাসন করতে চাইছে। 

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দিসানায়াকের রাজনৈতিক জীবনে টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাতে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে সেসময় বেশ সক্রিয় ছিল তার দল জেভিপি ও জোট এনপিপি।                        

গণঅভ্যুত্থানের একপর্যায়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।

সেই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের দাবি কোনও দল না করলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, দিসানায়াকে ছিলেন সেসময় শ্রীলঙ্কানদের আস্থার জায়গা। সরকার পতনের আন্দোলনে তার দল ও জোট প্রতিদিন কর্মসূচি রাখে। ধর্মঘট সফলে তার নেতাকর্মীদের জনসংযোগ ‍ছিল চোখে পড়ার মতো।   

ক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে পরিবারের বিদায়ের পর শ্রীলঙ্কায় যে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণে দিসানায়াকে বড় আঙ্গিকে পরিবর্তনের ডাক দেন। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জরুরত দিশাহারা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। আরও বেশি সোচ্চার হন দুর্নীতির বিরুদ্ধে।

এসব রাজনৈতিক তৎপরতা দিসানায়াকের দলকে অল্প সময়ের ভেতরে জনগণের আস্থার জায়গায় নিয়ে যায়। রূপান্তরিত করে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে।      

দিসানায়াকে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক গামিনি বিয়ানগোডা আল জাজিরাকে বলেন, “ব্যবস্থা পাল্টাতে তাকে আমার আন্তরিক মনে হয়েছে। দুর্নীতির দরজা তিনি সত্যিকার অর্থেই বন্ধ করে দিতে চান বলে আমার মনে হয়েছে।

“দিসানায়াকে শেষ পর্যন্ত দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন কি না, তা অন্য আলোচনা। তবে তার মধ্যে আমি যে আন্তরিকতা দেখেছি, তা অন্য কোনও নেতার মধ্যে দেখিনি।”   

বিপ্লবের পথ থেকে সরে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি

রাজধানী কলম্বো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরে থামবুত্তেগামা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৬৮ সালে জন্ম দিসানায়াকের। শ্রীলঙ্কার কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক করেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়। যুক্ত হন জেভিপিতে। ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।   

২০১৪ সালে দিসানায়াকেকে জেভিপির নেতা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি দলের লক্ষ্য, মতাদর্শ পরিবর্তনে হাত দেন। অতীতের রক্তাক্ত অধ্যায় থেকে জেভিপিকে বের করে এনে ভিন্ন আদল দিতে চান।      

মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে গত শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে ও আশির দশকের শেষে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয় জেভিপি। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জুনিয়াস রিচার্ড জয়াবর্ধনে ও রানাসিংহে প্রেমাদাসার শাসনকে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী হিসেবে দেখত দলটি।

এই দুই শাসনকে উৎখাতে তারা যে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল, তা শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী সময়। তখন প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ।

ব্যর্থ বিপ্লবের পর সেখান থেকে সরে এসে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করে জেভিপি। সেসময় দিসানায়াকেকে দলের পলিটব্যুরোতে নিয়োগ দেওয়া হয়।        

২০২২ সালে প্রেসিডেন্টের বাসভবন দখলে নেয় গণঅভ্যুত্থানকারীরা।

২০১৪ সালে জেভিপির নেতা হওয়ার পর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিসানায়াকে দলের অতীত অর্থাৎ ‘বিপ্লবকালে’ সংঘটিত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান।

তার এই ক্ষমা চাওয়ায় দলের কয়েকজন সদস্য ও শ্রীলঙ্কার বামপন্থি মহলের একাংশের তোপের মুখে পড়েন দিসানায়াকে। এরপর থেকে দলের অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাকে কৌশলী হতে দেখা যায়। বিপ্লবের সময়কার ঘটনা নিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার দুঃখপ্রকাশ করতে দেখা গেছে, তবে কখনোই ক্ষমা চাননি।

বিপ্লবের সময় শ্রীলঙ্কার বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, অবসর নেওয়া পুলিশ-সেনাবাহিনীর সদস্য, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা জেভিপির নির্মমতার শিকার হয়েছিল। দীর্ঘদিন তারা সাধারণ জনগণের কাছে আতঙ্কের অপর নাম ছিল।

জনমানস থেকে সত্তর ও আশির দশকের সেই স্মৃতি দূর করতে দিসানায়াকে দলের দায়িত্ব গ্রহণের পর পদক্ষেপ নেন।

একসময় যারা জেভিপির লক্ষ্যবস্তু ছিল সেই বুদ্ধিজীবী, শিল্পী থেকে শুরু করে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, বিরোধী মতাবলম্বীদের মধ্যে গত কয়েক বছরে সেতুবন্ধন নির্মাণে সক্ষম হন দিসানায়াকে। বিশেষ করে তার দুর্নীতি দমন অঙ্গীকারের মতো লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি শ্রীলঙ্কানদের মন জয় করে।

যা স্পষ্ট হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক গামিনি বিয়ানগোডার কথাতেই। তিনি বলেন, “১৯৮৯-৯০ সালে জেভিপি কী করেছিল, তার জন্য তাদের কড়া ভাষায় সমালোচনা করা আমি ঠিক মনে করি না। আজ আমরা যে জেভিপিকে দেখছি, তা আশির দশকের জেভিপি থেকে অনেক আলাদা।”           

আড়ালে সিংহলি বৌদ্ধ মতাদর্শ

২০২২ সালে সফল গণঅভ্যুত্থানের পর দুর্নীতির দমনের ইস্যুকে হাতিয়ার করে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির দিকে দিসানায়াকের দল ঝুঁকলেও তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়।            

শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ভারতের নাক গলানো পছন্দ নয় জেভিপির। তারা মনে করে, তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আশির দশক থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশটিকে বিভক্ত করে। এই আন্দোলন চলাকালে শ্রীলঙ্কার ওপর ভারতের প্রভাব সামনে আসে।             

তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের আগে জেভিপি নিজেই সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিলেও দলটি তামিল বিদ্রোহীদের সমর্থন করে না। তারা মনে করে, আলাদা রাষ্ট্র গঠনের তামিলদের লক্ষ্য শ্রীলঙ্কায় বিভাজন ‍সৃষ্টি করবে।

শ্রীলঙ্কান তামিলদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামকে সঠিক মনে করে না জেভিপি।

এ শতকের প্রথম দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে যখন তামিলদের বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করছিলেন, সেসময় তাকে পূর্ণসমর্থন দিয়েছিলেন দিসানায়াকে। তিনি বলেছিলেন, তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাজাপাকসে সরকারের যুদ্ধ সমর্থনের জন্য তিনি মোটেও অনুতপ্ত নন।                             

তামিল বিদ্রোহীদের দমনের কালে রাজাপাকসে সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গণহারে মানুষ হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যেসব অপরাধে জড়িত ছিল, তা তদন্তের জন্য শ্রীলঙ্কান তামিল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে।

কিন্তু জেভিপি নেতৃত্বাধীন এনপিপি জোট তাদের আহ্বানে কর্ণপাত করেনি। তারা মনে করে, এখানে তদন্তের কিছু নেই। দিসানায়াকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দোষী কাউকে শাস্তির দেওয়ার কথা তারা বলবে না। 

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিয়ানগোডা বলেন, “১৯৬৮ সালে রোহানা বিজেবিরার হাত ধরে জেভিপি প্রতিষ্ঠার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের মতাদর্শ সমর্থন করেছিল দলটি। ফলত গ্রাম-মফস্বলের সিংহলি বৌদ্ধ তরুণদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল জেভিপি।”               

দিসানায়াকের ‘বাণিজ্যবান্ধব চিন্তা

বলা বাহুল্য, অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। বিশ্লেষক থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের সমর্থকরা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে আইএমএফের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির যখন প্রশংসা করছে, তখন দিসানায়াকে বলছেন, জেভিপি আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসার চেষ্টা করবে, যাতে সাধারণ শ্রীলঙ্কানদের ওপর দুর্ভোগ তুলনামূলকভাবে কম হয়।

কলম্বোভিত্তিক বাজারমুখী গবেষণা সংস্থা অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ধননাথ ফারনান্দো বলেন, “দিসানায়াকের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক নীতি তার একসময়ের সমাজতান্ত্রিক অবস্থান থেকে একদমই আলাদা।

“তিনি এখন বাণিজ্যবান্ধব পদক্ষেপ, ব্যবসার পরিবেশ উন্নতকরণ, কর ব্যবস্থার পুনরায় সংস্কার, শুল্ক সরলীকরণ, দুর্নীতি দমন ও উন্নয়নের জন্য বেসরকারি খাতকে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছেন।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত