বাড়ির বড়রা থেকে শুরু করে ফেইসবুকের হেলথ টিপস পেইজ, সবারই ওই এক কথা। বেশি বেশি পানি খাও। পানি কম খাওয়ার অভ্যাসের কারণে বাড়িতে বকুনি খায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই ভার। ফলে “বেশি পানি খাওয়া ভালো” এমন ধারণা নিয়েই আমাদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু কতটা ভালো তা কি আমরা জানি?
পানির গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সঠিক ভারসাম্য বজার রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অতিরিক্ত পানি পান করা থেকেও সৃষ্টি হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি। আর এই স্বাস্থ্যঝুঁকিকে বলা হচ্ছে ‘ওয়াটার ইন্টক্সিকেশন’। বাংলা করলে দাঁড়ায় পানি বিষক্রিয়া।
সত্যিই কি বেশি পানি খাওয়া থেকে এমন বিষক্রিয়া হতে পারে?
ভারতের সি কে বিড়লা হসপিটালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট ড. তুষার তায়াল বলেন, “ওয়াটার ইন্টক্সিকেশনের আছে আরও একটি নাম। একে হাইপোন্যাট্রেমিয়া হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এটি তখনই ঘটে যখন কেউ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অতিরিক্ত পরিমাণে পানি খেয়ে ফেলে। যা কিনা রক্তে সোডিয়ামের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়।”
তিনি বলেন, “সোডিয়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ ইলেক্ট্রোলাইট যা কোষের ভেতরে এবং বাইরে তরলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদি কিডনি অতিরিক্ত পানি সঠিকভাবে অপসারণ করতে না পারে, তখন অতিরিক্ত পানি কোষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং সেগুলিকে ফুলিয়ে দেয়”
একই হসপিটালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. পি ভেঙ্কটকৃষ্ণন এর মতে, সোডিয়াম শরীরের স্নায়ুবিক সংকেত আদান প্রদানের জন্য দায়ী খনিজ। এছাড়া পেশীর কার্যকয়ারিতা এবং তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এই খনিজটির প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত সোডিয়াম ছাড়া শরীরের কোষ তার স্বাভাবিক কার্যক্রম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে একধিক অঙ্গ আক্রান্ত হয়।
ড. কৃষ্ণন বলেন, “কিডনি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.৮ থেকে ১ লিটার পানি ছেকে নিতে পারে। এর থেকে বেশি পানি খেলে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যার ফলে শরীরে পানি জমে যায় এবং রক্তের ঘনত্ব কমে যায়।”
শরীরে পানি মাত্রা ছাড়ালে, এটি রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে এবং রক্তে উপস্থিত খনিজের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। ফলে কোষে চাপ তৈরি হয়। এতে করে শরীরের টিস্যুগুলো ফুলে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কে।
ড. তায়ালের মতে, এই ফুলে যাওয়া তাৎক্ষনিকভাবে কোন ক্ষতি করেনা। তবে যদি এই ঘটনা ঘটে মস্তিষ্কে, তখন ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেয়।
তায়াল স্মরণ করিয়ে দেন, মস্তিষ্ক খুলি দ্বারা আবৃত। যে কারণে মস্তিষ্ক ফুলে গেলে মাথার খুলিতে চাপ পড়ে। আর শরীরের এই অবস্থাকে বলা হয় “সেরেব্রাল অডেমা”।
তায়াল বলেন, “এই অবস্থায় খুলিতে চাপ তৈরি হয়। যার ফলে মাথাব্যথা করে, বিভ্রান্তি অনুভূত হয়, শরীরে জ্বর আসে এমনকি ব্যক্তি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে চলে যেতে পারেন।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, “ওয়াটার ইনটক্সিকেশন” এর লক্ষণগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক হতে পারে।
লক্ষণগুলো হলো-
- বিভ্রান্তি
- মাথাব্যথা
- ক্লান্তি
- পেশীর খিঁচুনি
- জ্বর (গুরুতর ক্ষেত্রে)
- কোমা (চরম ক্ষেত্রে)
মূলত মস্তিষ্ক ফুলে যাওয়ার ফলস্বরূপ এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। মস্তিষ্কের কোষে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এমনটি ঘটে।
তাহলে দৈনিক কী পরিমাণ পানি শরীরে প্রয়োজন?
ড. তায়াল উল্লেখ করেন, জলবায়ু, শারীরিক কার্যকলাপ এবং শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে শরীরে পানির চাহিদা তৈরি হয়।
তায়াল এর মতে, একজন পুরুষের প্রতিদিন গড়ে ৩.৭ লিটার পানি প্রয়োজন। আর একজন নারীর দরকার হয় গড়ে ২.৭ লিটার।
এই পরিমাণ পানির উৎস যে কেবলই পানি হতে হবে তা নয়। অন্যান্য খাবার থেকেও হতে পারে।
তায়াল আরও বলেন, শরীর কী চায় তা শুনতে হবে। বেশি বেশি পানি খাওয়ার ব্যাপারে থাকতে হবে সতর্ক। তিনি মূলত শরীরের চাহিদা অনুইযায়ী পানি খাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এদিকে ড. কৃষ্ণন এর মতে, ২ থেকে ৩ লিটার পানি কেবল মাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
যারা ব্যয়াম করে ঘাম ঝরায় তাদের অবশ্য আরও বেশি পানি দরকার হতে পারে। গরম এবং শুকনো আবহাওয়ায় যারা বসবাস করে তাদেরও স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি পানি প্রয়োজন হয়।