গত মাসের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হাজারো মানুষের মৃত্যুতে ভারাক্রান্ত মিয়ানমার এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায়। তবে তার চেয়ে আরও ভয়াবহ এক বিপর্যয়, যা কি না মানুষসৃষ্ট, এখনও দেশটির ভবিষ্যতের ওপর ছায়া ফেলছে।
গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারে চার বছর ধরে লড়াই চলার পর সামরিক শাসন গোষ্ঠী ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
তবে ভূমিকম্পের প্রভাব সামনের বছরগুলোতে চলমান সংঘাতের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত মার্চের ২৮ তারিখ মিয়ানমারের মধ্য সাগাইং অঞ্চলে আঘাত হানা ভূমিকম্পে অন্তত ৩ হাজার ৬৪৯ জন নিহত হয়। আহত হয় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে এখনও নিখোঁজ ১৪৫ জন।
ভূমিকম্পে সাগাইং শহর ও আশপাশের মান্দালয় অঞ্চলে ঘরবাড়ি, কারখানা, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ধসে পড়ে; ভেঙে পড়ে সেতু, ফাটল ধরে সড়কে।
ভূমিকম্পের ফলে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এই তথ্য জানিয়েছেন ২০২২ সালে সেনাবাহিনী ছেড়ে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাবেক মেজর তিন লিন অং।
তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীতে সামরিক সরঞ্জামের সঙ্কট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কারণ সম্প্রতি সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার করা গুলির খোসা ও কামানের গোলার খোলগুলোতে চলতি বছরের উৎপাদন তারিখ দেখা গেছে।”
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “সেনাবাহিনীতে থাকাকালে আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, কিছু গুলি তো আমাদের বয়সকেও ছাড়িয়ে যাবে। আর এখন সেগুলো তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবহার করতে হচ্ছে।”
সেনাবাহিনীর গোলাবারুদ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটার খবর এমন সময় এসেছে, যখন মিয়ানমারের সেনানিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।
তবে মিয়ানমারের প্রধান শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর ওপর এখনও কড়া নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে সেনাবাহিনী।
তারা শহরাঞ্চলে ঘাঁটি গেঁড়ে গ্রামাঞ্চলে নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছে, জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামগঞ্জ; যা জাতিসংঘের মতে, যুদ্ধাপরাধের শামিল।
সেনাবাহিনীর চেয়েও সক্রিয়
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সাগাইং শহর এখনও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তবে এর চারপাশের গ্রামাঞ্চলের অনেকাংশ বিদ্রোহী গোষ্ঠী শাসন করছে।
যেমন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ); যারা বিদ্রোহী জোটের জাতীয় ঐক্য সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত।
আত্মরক্ষামূলক অভিযান ছাড়া ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বিদ্রোহীদের সরকার। তবে সেখানে সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
জাতীয় ঐক্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান হামলা ও কামানের গোলার আঘাতে গত ২৮ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ৭২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
সেনাবাহিনীর বিমান হামলায় ১০ এপ্রিল আরও দুজন বেসামরিক নাগরিক মারা যান, যাদের একজন ১৩ বছরের এক কিশোরী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাগাইংভিত্তিক পিডিএফের এক যোদ্ধা জানান, কিছু বিদ্রোহী ইউনিট মিয়ানমারের কেন্দ্রে ত্রাণ কার্যক্রমে মনোযোগ দিয়েছে। যদিও তাদের প্রতিপক্ষরা যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে।
এই নারী যোদ্ধা বলেন, “ভূমিকম্পের পর যুদ্ধবিরতির সুযোগ নিয়ে সাগাইং-মোনওয়া সড়ক আরও নির্বিঘ্নে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী।”
সাগাইংয়ে পিডিএফ বাহিনীর ধারণা, এ মাসে যুদ্ধবিরতি শেষ হলে সংঘর্ষ আরও তীব্র হবে।
ওই নারী যোদ্ধা বলেন, “পিডিএফ এখানে সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চয় করছে। আর জাতীয় ঐক্য সরকার এখন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আগের চেয়ে আরও কার্যকরভাবে সমন্বয় করছে।”
আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিসের ধারণা, ভূমিকম্প সেনাবাহিনীর কৌশলগত উদ্দেশ্য থেকে মনোযোগ সরাবে না। তাছাড়া বেশিরভাগ সেনাই ত্রাণ কাজে অংশ না নিয়ে তাদের ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, “সেনাবাহিনী ত্রাণ কাজের জন্য বিরতি নিচ্ছে না। তারা আকাশ থেকে আক্রমণ অব্যাহত রাখবে এবং যেখানে সম্ভব, পিডিএফকে দুর্বল করতে স্থলপথে আক্রমণ চালাবে।
“তবে রাখাইন রাজ্য, যেটি ভূমিকম্প থেকে বলতে গেলে অক্ষতই রয়েছে, এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র,” বলেন তিনি।
রাখাইনে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সিত্তে এবং কিউকফিউ অঞ্চলের চারপাশে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। ওই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাইপলাইন রয়েছে, যা মিয়ানমার থেকে চীন পর্যন্ত গ্যাস পরিবহন করে।
ডেভিস বলেন, “আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চল থেকে দেশটির কেন্দ্রস্থল মাগবি, বাগো ও ইয়াওয়েদি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে।
“তারা হলো সেই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, যারা এই সংঘর্ষকে একদিকে বা অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারে।”
আনুমানিক ৪০ হাজার সৈন্যের আরাকান আর্মির জান্তার বাহিনীকে পরাজিত করার প্রমাণিত ইতিহাস রয়েছে।
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যের এক বিদ্রোহী কমান্ডার বলেন, “ভূমিকম্প মিয়ানমারের শরণার্থী সম্প্রদায়ের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যারা আগে থেকেই যুদ্ধের ভার বহন করে চলেছে।
“যে পক্ষ জনগণের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী, তারাই জনসমর্থন অর্জন করতে পারবে এবং সামনের লড়াইয়ে জয়ী হবে।”
মিয়ানমারের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেনাবাহিনী এখন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে।
ভূমিকম্পের পর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি আট মাস ধরে অবরোধের পর গত ৭ এপ্রিল মিয়ানমারের উত্তরে সাগাইং অঞ্চলের ইন্দাউ শহর দখল করে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে চিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা সম্প্রতি ফালাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, যদিও তারা কোনও যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিয়াও সান হ্লাইং জানান, সেনাবাহিনী এখনও ভূমিকম্প পরবর্তী ধাক্কা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এই সুযোগে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর জন্য আরও শহর দখলের পথ তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, “বিদ্রোহীদের অগ্রগতি ধাপে ধাপে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে বাগো ও মাগবির মতো অঞ্চলে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের নিয়ন্ত্রণ ও সঙ্কটকালে অভিযোজিত হওয়ার সক্ষমতা ভুললে চলবে না।
“তবে দীর্ঘমেয়াদে ভূমিকম্প মিয়ানমারের ক্ষমতার ভারসাম্যে মৌলিক পরিবর্তন আনবে বলে আমার মনে হয় না।”
দ্বৈব হস্তক্ষেপ
ভূমিকম্প মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে বড় সঙ্কটে ফেলতে পারেনি সত্য, তবে জেনারেলদের ওপর মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করেছে।
যে দেশে জ্যোতিষশাস্ত্র এবং কুসংস্কার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে, সেখানে অনেকেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ঐশ্বরিক শাস্তি হিসাবে দেখছেন।
সাবেক মেজর তিন লিন অং বলেন, “তারা এই ভূমিকম্পকে ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ বা রাজার ভুলের শাস্তি হিসেবে দেখছেন। আমি যা শুনেছি, তাতে তারা সরাসরি তাকে (শাসক মিন অং হ্লাইং) দোষ দিচ্ছে না। তবে তার নেতৃত্ব এবং সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।”
তিন লিন অং জানান, শাসকগোষ্ঠী দেশব্যাপী সরকারি কর্মচারীদের একটানা নয় দিন প্রতিদিন নয় বার করে একটি বৌদ্ধ মন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিয়েছে। কেননা বৌদ্ধ বিশ্বাসে নয় সংখ্যাটি শুভ প্রতীক বহন করে।
তিনি ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহায়তা চাওয়া, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা এবং আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্তির কথাও বলেন।
“তারা জানে, তাদের প্রতি জনগণের ঘৃণা দিন দিন বাড়ছে এবং তাদের নেতা দিশেহারা বলে মনে হচ্ছে।”
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হর্সি বলেন, যদিও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এই অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যাগুলোকে নাকচ করেন, তবুও তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের ব্যক্তিরা এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে বলে দুর্বলতার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়।
তিনি মনে করেন, এটি অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানের কারণ না হয়ে ভূমিকম্পটি একটি খারাপ লক্ষণ হিসাবে মিন অং হ্লাইংয়ের কর্তৃত্ব হ্রাস এবং প্রকাশ্য সমালোচনার উত্থান ঘটাতে পারে।
রিচার্ড হর্সি বলেন, “আপনি সেখান থেকে এমন পরিস্থিতিতে যাবেন, যেখানে লোকেরা মনে করবে তারা তার আদেশ উপেক্ষা করে নিজেদের মতো কাজ করতে পারে, কারণ অন্য সবাই তাদের সাথে একমত, তার সাথে নয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কিয়াও সান হ্লাইং বলেন, কিছু সূত্র ইঙ্গিত দেয় যে সামরিক শাসনের পতনের পূর্বাভাস হিসেবে ভূমিকম্পকে প্রচারের জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। তবে সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত করতে পারে, এমন অনেক কারণের মধ্যে এটি কেবল একটি।
ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হলেও তা গৃহযুদ্ধকে প্রভাবিত করবে, এমনটা অনুমান করা কঠিন বলে মনে করেন হর্সি।
তিনি বলেন, সংঘাতে জড়িত শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সম্ভবত ভূমিকম্পের পরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে আরও অনিচ্ছুক হবে।
“এমনকি যদি আপনি আপসের একটি মনোভাব পেতেনও, যদিও এমন কিছু এখনও অস্তিত্বহীন,” বলেন হর্সি।
এখনও মিয়ানমারে খুব কম মানুষই কোনও শান্তি চুক্তি বা যুদ্ধবিরতি চুক্তির ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর আন্তরিকতাতে বিশ্বাস করে।
“কে সেই কাগজের টুকরোটিকে বিশ্বাস করবে, যখন এটি এমন একটি সামরিক বাহিনী দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়,” বলেন হর্সি।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা