ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কার্যকর কোনও চুক্তি হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। একাধিকবার উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তির জন্য আলোচনা হয়েও তা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, চুক্তির জন্য ক্রমশ আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে।
কায়রোতে একাধিক পক্ষের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির চেষ্টা এখনও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রও যে যুদ্ধবিরতি চায়, এর বড় প্রমাণ হয়তো কায়রোতে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রধান উইলিয়ামস বার্নসকে পাঠানোর ঘটনা।
হামাস চাইছে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ফিলিস্তিন থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও বাস্তচ্যুত ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমে ফিরে আসার অধিকার।
অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চাইছেন হামাসকে সম্পূর্ণ পরাস্ত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। একই সঙ্গে জিম্মি ইসরায়েলিদেরও ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য তার।
২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা জিলাদ শালিতকে হামাসের হাত থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন ঘেরসন বাসকিন। তার মতে, “ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। আর হামাসকে চাপ দিচ্ছে মিশর ও কাতার।”
তিনি বলেন, “সিআইএ প্রধানের উপস্থিতির কারণে আলোচনার সব পক্ষকেই উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। এই ঘটনা আমেরিকার পক্ষ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের ইঙ্গিত দেয়।”
কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চুক্তি হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশটির প্রধান মিত্রদের মধ্যে তীব্র হতাশার মধ্যেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা চুক্তির ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তও জানান যে, এখনই চুক্তি করার উপযুক্ত সময়।
চুক্তিতে ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ইস্যুতেই গত নভেম্বরে আংশিক যুদ্ধবিরতি হয়েছিল।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, গাজায় এখনও ১৩৩ ইসরায়েলি জিম্মি আছেন। ৩০ জিম্মি এরই মধ্যে মারা গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাবের অধীনে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির প্রাথমিক পর্যায়ে হামাস ৪০ জীবিত জিম্মিকে মুক্তির কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ ও অসুস্থ নারী বন্দিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা রয়েছে।
আর এমনটা হলে ইসরায়েল ৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এরমধ্যে ইসরায়েলি হত্যায় দণ্ডিত ১০০ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বন্দিও রয়েছে।
তবে হামাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র জিম্মি মুক্তির যে ক্যাটাগরি দিয়েছে সে অনুসারে ৪০ জিম্মি তাদের কাছে নেই। গোষ্ঠীটির এমন বক্তব্যের ফলে বোঝা যাচ্ছে, ধারণার চেয়েও বেশি সংখ্যক জিম্মি হয়তো প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদের হাতে মারা গেছেন এরই মধ্যে।
ইসরায়েলে নেতানিয়াহুও একাধিক পক্ষের ব্যাপক চাপে আছেন। অধিকাংশ ইসরায়েলি যুদ্ধের সমর্থনে থাকলেও জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চাপ তাদের পক্ষ থেকেও আছে।
বন্দিদের ফিরিয়ে আনাকে অগ্রাধিকার না দেওয়ার এবং নিজের রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহু সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, এমন অভিযোগ রয়েছে হামাসের কাছে জিম্মি হওয়া সদস্যদের পরিবারগুলোর। তারা নিয়মিত বিক্ষোভও করছেন। নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চাইছেন তারা।
নেতানিয়াহুর জোটের মধ্যেও বিভাজন তীব্র হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অতি-ডান, কট্টর জাতীয়তাবাদী মিত্র, যারা হামাসকে ছাড় না দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছে।
অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে ও হামাসকে ধ্বংসের একমাত্র উপায় গোষ্ঠীটির ওপর চাপ বাড়ানো।
অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির স্পষ্টভাবে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো- নেতানিয়াহুকে তার প্রতিশ্রুতি অনুসারে গাজার সর্বদক্ষিণের রাফা শহরে হামলা চালাতে হবে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও চাইছেন রাফায় অভিযান চালাতে। তারা মনে করেন, হামাসের চারটি অপারেশনাল ব্রিগেড ও জ্যেষ্ঠ নেতারা সেখানে লুকিয়ে আছেন।
কিন্তু কার্যত ইসরায়েলের বাইরের সবাই রাফায় আক্রমণের বিরুদ্ধে। সেখানে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে বড় পরিসরে হামলা হলে বহু বেসামরিক মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে।
অভ্যন্তরীণ আলোচনা-সমালোচনা মধ্যেই গত সোমবার নেতানিয়াহু জানান, রাফায় অপারেশনের জন্য এরই মধ্যে একটি সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
মধ্যস্থতাকারী বাসকিন বলেন, “নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এখন তার সরকার ও লিকুদ পার্টির মধ্যেই বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। নেতানিয়াহু স্বাধীন নন। তিনি তার নিজের সরকারের কাছেই বন্দি।”
হামাস এখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বলেছে যে, প্রস্তাবে তাদের জনগণের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবি পূরণ করা হয়নি। এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, “ইসরায়েলের অবস্থান এখনও অনড়।”
গাজার হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার সম্ভবত একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি ইসরায়েলি জিম্মিদের নিয়ে কোনও টানেলে লুকিয়ে আছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা কঠিন। বলা হয় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে একাধিক মধ্যস্থতাকারীকে জড়িত করতে হয় এবং এতে কয়েকদিন সময় লাগে।
হামাসের শঙ্কা, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি না হলে ইসরায়েল বন্দি বিনিময়ের পর আবারও গাজায় হামলা করবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি