Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

নারী কোটা বাতিল মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে

সারা হোসেন

মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আইনজীবী সারা হোসেন মনে করেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার গেজেট সংশোধন করে নারী কোটা পুনর্বহাল করা এবং অন্যান্য কোটার যৌক্তিকীকরণের সুযোগ এখনও আছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, যখন তথাকথিত মৌলবাদীরা ক্ষমতায় নেই তখন কেন নারী কোটা বাতিল হচ্ছে? দেশের নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এই আইনজীবী বলছেন নারী কোটা বাতিল করা মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

নারী কোটা বাতিল মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে

সারা হোসেন

মানবাধিকারকর্মী ও বিশিষ্ট আইনজীবী সারা হোসেন মনে করেন, সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার গেজেট সংশোধন করে নারী কোটা পুনর্বহাল করা এবং অন্যান্য কোটার যৌক্তিকীকরণের সুযোগ এখনও আছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, যখন তথাকথিত মৌলবাদীরা ক্ষমতায় নেই তখন কেন নারী কোটা বাতিল হচ্ছে? দেশের নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এই আইনজীবী বলছেন নারী কোটা বাতিল করা মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সকাল সন্ধ্যা: কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত রোববার হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে আগের কোটা ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে বাতিল করল সর্বোচ্চ আদালত। এই রায়ের ফলে ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডের চাকরিতে সব নারী কোটাও বাতিল হলো। অথচ দেশে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এই নারী কোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল। এছাড়া সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে অনগ্রসর শ্রেণি-গোষ্ঠীর অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় নারী কোটা বাতিলের বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সারা হোসেন: আমার মনে হয় সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ ছাড়াও নারী কোটা রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরেকটা ক্ষমতা দেওয়া আছে, যেটা সংবিধানের ২৮-৪ এ বলা আছে যে— নারীদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই ক্ষমতা তো আছেই। আর সংবিধানের ২৯-৩ এ বলা আছে কর্মসংস্থানের বিষয়ে, অনগ্রসরদের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা। এখন আদালত থেকে যে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে সেখানে প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা রাখার কথা বলা হয়েছে। সেখানে নারীদের কোটা রাখা হয়নি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের জন্য কোটা রাখা হয়েছে।

এখন কি তাহলে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ পরিবারগুলোকে ‘অনগ্রসর’ বলা হচ্ছে? কোন ক্ষমতাবলে তাদের জন্য কোটা রাখা হয়েছে সেটা পরিষ্কার না। আদালতে এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক সাবমিশান হয়েছে, অনেক প্রশ্ন আদালত থেকে করা হয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধারা কি ‘অনগ্রসর’ গোষ্ঠী বা শ্রেণি কি না? একজন ছাড়া বাকি সবাই বলেছে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধারা ‘অনগ্রসর’ না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটাটা কোন সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাখা হলো? এই প্রশ্নটা আসলেই ওঠা উচিৎ। এটা কিন্তু রায়ে বা গেজেটে কোথাও স্পষ্ট করা হয়নি।

আরেকটা বিষয় হলো, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা বা শহীদ পরিবাররগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের, তাদের সন্মান জানানোর কিন্তু চাকরিতে কোটা রাখা একমাত্র উপায় হতে পারে না। অনেকভাবেই সেই সন্মান জানানো যায়। আবার মুক্তিযোদ্ধারা কোটার সুবিধা পেতে পারেন, যদি তারা ‘অনগ্রসর’ হিসেবে বিবেচিত হন। কোনও কোনও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার অনগ্রসর গোষ্ঠীর হতেও পারেন, হতে পারেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর, হতে পারেন প্রতিবন্ধী। সেভাবেও তারা কোটা পেতে পারেন। কিন্তু অ্যাজ অ্যা গ্রুপ, অ্যাজ অ্যা সেকশন মুক্তিযোদ্ধাদের কি আমরা অনগ্রসর ধরব কি না? এটাও তো আসলে একধরনের অবমাননা তাদের প্রতি।      

আমার মনে হয় সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ ছাড়াও নারী কোটা রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরেকটা ক্ষমতা দেওয়া আছে, যেটা সংবিধানের ২৮-৪ এ বলা আছে যে— নারীদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে। সেই ক্ষমতা তো আছেই।

এখন নারীর জন্য কোটার বিষয়ে আসি। নারীদের জন্য যেমন আলাদা কোটা রাখা হয়নি তেমনি যে কোটাগুলো রাখা হলো, সেখানেও কিন্তু নারীদের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। ধরুন প্রতিবন্ধী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য যে কোটা রাখা হলো সেখানে ওই শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত নারীরা কত শতাংশ পাবেন সেটা উল্লেখ করা যেত। সেটাও করা হয়নি। ফলে এসব কোটার বেশিরভাগ যদি পুরুষদের ভাগে চলে যায় সেটাও আরেক বৈষম্য তৈরি করবে।

সকাল সন্ধ্যা: সব ক্ষেত্রে নারী কোটা বাতিলের কারণে আরও কিছু প্রশ্ন উঠছে। যেমন নারীর অগ্রযাত্রার জন্য শিক্ষায় সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় এবং স্নাতক বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মেয়েদের নানারকম শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, নারীর শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ করা হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীর কোটা বাতিল করা হলো। এদিকে আমরা আরও দেখলাম যে, আদালতের রায়ের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকদের কোটাও বাতিল করা হলো। এটা কি রাষ্ট্রের নারী উন্নয়ন নীতির ক্ষেত্রে স্ববিরোধী হয়ে গেল না?   

সারা হোসেন: আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আপনি যদি সংবিধানের প্রিয়াম্বেল দেখেন, ৮ ধারা দেখেন, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে এই রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সংবিধানের মূল লক্ষ্য। এবং এটা মুক্তিযুদ্ধেরও একটা স্পষ্ট লক্ষ্য, যেহেতু আমরা বৈষম্যবিরোধী একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৈষম্যমুক্ত একটা সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এখন সংবিধানের ২৮-৪, ২৯-৩ ধারায় যেসব বিশেষ ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে তারও লক্ষ্য সমাজকে বৈষম্যমুক্ত করা, সমতা প্রতিষ্ঠা করা।

এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর জন্য সমতা নিশ্চিত করতে পেরেছি? পারিনি। ফলে ওই অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদেরকে শুধু শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে না বরং সব ক্ষেত্রেই নারী এবং অন্যান্য শ্রেণি-গোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুটো কারণে এটা দরকার। এক, নারীর জন্য সমান সুযোগ আর দুই, আমাদের রাষ্ট্রে যাতে আমাদের সমাজের বৈচিত্র ফুটে ‍ওঠে, সবার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় সেজন্যও এটা দরকার। তাই এটা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয় সবক্ষেত্রেই লাগবে। আরও গবেষণা করে দেখতে পারেন, বিবিএস-এর বা আমাদের আরও যেসব সমীক্ষা আছে, জরিপ আছে, কোথাও কি আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নারীরা অগ্রসর হয়ে ৫০ শতাংশ সুযোগ পেয়ে গেছে? মনে হয় না পাবেন। তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সেই অবস্থায় পৌঁছাতে পারছি ততক্ষণ আমাদেরকে এমন সব কোটা বা বিশেষ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সেটা না করে নারী কোটা বাতিল করা হলো।

আরেকটা কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, এই যে প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ, আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটা ১ শতাংশ রাখা হলো, এটা কি কোনও গবেষণা বা জরিপের ভিত্তিতে রাখা হলো? তাহলে আগে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটা কেন ৫ শতাংশ রাখা হয়েছিল আর এখন কেন ১ শতাংশ থাকবে? এটা করার যেমন যৌক্তিকতা থাকতে হবে তেমনি গবেষণার ভিত্তিতে বাস্তব প্রমাণগুলোও সামনে আনতে হবে।     

সকাল সন্ধ্যা: আদালত যে রায় দিল সেটা কোনও গবেষণার ভিত্তিতে বা বস্তুনিষ্ঠ কোনও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে করা হয়েছে বলে আমরা শুনিনি বা কেউ সেটা দাবিও করেনি। এখন তাহলে কী করা উচিৎ?   

সারা হোসেন: আমরা বুঝতে পারছি যে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায় সবাই এখন এটা নিয়ে চুপ করে আছে বা একপ্রকার মেনে নিয়েছে। ওইদিন আদালত এই রায় দিয়েছে আর সরকারও এটার প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্যই আমাদের এখন এই প্রশ্নগুলো তোলা উচিৎ। খেয়াল করা দরকার, আদালতও কিন্তু বলেছে, কোটার বিষয় নির্ধারণ করার এখতিয়ার আদালতের নাই, তারা একটা সুপারিশ করেছে। সরকারই কিন্তু গেজেট জারি করে এটা চালু করল। কার জন্য কত শতাংশ রাখা হবে সেসবের জন্য তো কেউ আদালতে কোনও কিছু নিয়ে আসেনি, কোনও পরিসংখ্যান, জরিপ, গবেষণা কিচ্ছু না।

আমার মনে হয়, সরকার যে গেজেট প্রকাশ করেছে সেটা সংশোধন করার সুযোগ আছে। হয়তো ক্রাইসিস মোকাবেলা করার জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু ক্রাইসিস এভাবে মোকাবেলা না করলেও হতো। কারণ ছাত্ররা তো অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করেছে। এসব নিয়ে ভাবার, কাজ করার তো সময় ছিল।

প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরও কিন্তু লিঙ্গীয় পরিচয় আছে। কেউ নারী, কেউ পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ। এসব ক্ষেত্রেও তাই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা দরকার। আমার মনে হয়, সরকার যে গেজেট প্রকাশ করেছে সেটা সংশোধন করার সুযোগ আছে। হয়তো ক্রাইসিস মোকাবেলা করার জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু ক্রাইসিস এভাবে মোকাবেলা না করলেও হতো। কারণ ছাত্ররা তো অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করেছে। এসব নিয়ে ভাবার, কাজ করার তো সময় ছিল। আমার মনে হয় কোটা ব্যবস্থার স্পষ্ট ও যৌক্তিক সংস্কারের এখনও সুযোগ আছে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনি বলছিলেন যে আমরা কি নারী-পুরষ সমতার অবস্থায় পৌঁছে গেছি কি না? জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ হিসেবে নারীরা কি শিক্ষায়-চাকরিতে ৫০ ভাগের অংশীদার হয়েছে কি না? সেটা তো অনেক দূরের কথা, বরং আমরা দেখছি যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার হার সমান হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যে নারীরা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করছে তারাও চাকরি বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। আবার আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণাতেও দেখছি যে, উচ্চশিক্ষায় সফল নারীরাও চাকরির বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাধার কথা উঠে এসেছে গবেষণায়।    

সারা হোসেন: আমাদের যে নারী অধিকার সনদ রয়েছে ‘সিডও’ (CEDAW), জাতিসংঘের এই সনদে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরকারী, সেখানেও স্পষ্টভাবে বলা আছে বৈষম্য নিরসনের জন্য কোটার মতো এমন নানা সাময়িক বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত নারীদের জন্য সমান অধিকার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে। এটা শুধু শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রেই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের জন্যও প্রযোজ্য। জাতিংসংঘ কয়েক বছর পরপর ‘সিডও’ সনদ অনুসারে বাংলাদেশসহ সব দেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে থাকে। প্রত্যেকবারই বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতিসংঘকে জানায় যে, নারীরা যাতে সমতায় পৌঁছাতে পারে সেজন্য আমরা বিশেষ কোটা চালু রেখেছি। জাতিসংঘের ওই কমিটিও এজন্য বাংলাদেশকে প্রশংসা করে এবং এটা চালু রাখার উৎসাহ দেয়।

জাতিসংঘ একইসঙ্গে বাংলাদেশকে এই কোটা রাখার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়, যাতে সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য কমে আসে। মনে রাখা দরকার কোটা শুধু একটি পদক্ষেপ, শুধু কোটা দিয়ে তো সব হবে না, আরও পদক্ষেপ, আরও নানা নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু কোটা অবশ্যই লাগবে কারণ কোটা ছাড়া অন্যান্য সুযোগগুলোও কাজে লাগানো যায় না। আর কোটা রাখার সুযোগ তো রাষ্ট্রকে দেওয়াই হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: এখনসরকারি চাকরি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী কোটা বাতিল করা হলেও আমরা জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের জন্য বিশেষ কোটা বা ৫০ টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। আবার ‘আরপিও’ বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সব রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের সব কমিটিতে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে নারীর কোটা থাকবে না কিন্তু রাজনীতিতে নারীর কোটা থাকবে, এটা কি নারী উন্নয়ন নীতির ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয় না?

সারা হোসেন: সাংঘর্ষিক তো বটেই। তবে, জাতীয় সংসদে যে সংরক্ষিত আসন আছে সেটাও বিতর্কিত। নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকেও এটা নিয়ে প্রশ্নও তোলা হয়েছিল। আসলে এটাও তো একটা সাময়িক ব্যবস্থা। অনেক আগেই প্রশ্ন উঠেছিল যে, এখনও জাতীয় সংসদে এটা থাকবে কি না। দুটো মামলাও হয়েছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে, সংসদে কোটা থাকতে পারে। কিন্তু নারী আন্দোলন থেকে দাবি করা হয়েছিল যে, সংরক্ষিত আসনের নামে সিলেকশন বা মনোনয়নভিত্তিক ব্যবস্থা নয় বরং সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারীর জন্য আসন সংরক্ষণ করা হোক। নারীরা অন্তত এতটুকু প্রমাণ করার সুযোগ পাক যে তারা মনোনীত নয় নির্বাচিত হয়েই জাতীয় সংসদের যাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।

যদিও আমি এমন পার্লামেন্টারি কোটার পক্ষে না কিন্তু এটা খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন যে, জাতীয় সংসদে নারীর জন্য কোটা থাকবে কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীর জন্য কোটা থাকবে না কেন? আসলেই এটা যৌক্তিক না। কোটার মূল বিষয়টাই কিন্তু এই যৌক্তিকতা, সেটা নারী বা অন্য যে শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্যই হোক।

নারী কোটা বাতিল করা মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার সবাইকেই শক্তিশালী করবে। এটাই খুব হতাশার বিষয় যে, যখন তথাকথিত মৌলবাদীরা ক্ষমতায় নেই তখন কেন নারী কোটা বাতিল হচ্ছে?

সকাল সন্ধ্যা: আবারও নারী নীতির কথায় আসছি। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি সরকারের নারী নীতির বিরোধিতা করে মৌলবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ থেকে নানারকম রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছে। প্রকাশ্য হুমকিও দিয়েছে এবং মেয়েদের খেলাধুলা থেকে শুরু করে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছে। যেখানে দেশে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করার, সমাজে পশ্চাৎপদ অবস্থান থেকে নারীর অগ্রযাত্রার বিরোধিতা করার এমন গোষ্ঠীগুলো আছে, সেখানে সরকারি চাকরিতে নারী কোটা বাতিল কি কোনও ভুল বার্তা দেবে না? এটা কি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে আরও উসকে দেবে না? জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার, বিশেষত নারী অধিকার আন্দোলনে সক্রিয় একজন আইনজীবী হিসেবে আপনি কী মনে করেন?   

সারা হোসেন: ধর্মীয়মৌলবাদীদেরকে উসকে দিতে পারে, কিন্তু শুধু মৌলবাদী তো নয়, পিতৃতান্ত্রিক যারা আছে তারাও এতে উসকানি পেতে পারে। শুধু মৌলবাদীদের মধ্যে তো নয়, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ধ্যান-ধারণার লোকজন তো সমাজে রাষ্ট্রে সবখানেই আছে। ফলে, নারী কোটা বাতিল করা মৌলবাদী গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার সবাইকেই শক্তিশালী করবে। এটাই খুব হতাশার বিষয় যে, যখন তথাকথিত মৌলবাদীরা ক্ষমতায় নেই তখন কেন নারী কোটা বাতিল হচ্ছে? এবং কোনওরকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই এটা বাতিল করা হলো।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সারা হোসেন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত